যুদ্ধজয়
(ফেসবুকের নিউজ ফিডে ভেসে ওঠা একটা পোস্ট থেকে অনুপ্রাণিত। দুর্ভাগ্যক্রমে পরে আর খুঁজে পেলাম না তাই কার পোস্ট বলতে পারলাম না। দুঃখিত)
"বেরিয়ে যাও, যেখানে ইচ্ছে যাও। খালি আমাকে আর জ্বালিও না। তোমার কেনা দাসী পাওনি যে যা চাইবে তাই হবে।" সজোরে মুখঝামটা দিয়ে বলে উঠল তিতলি। আমার সহধর্মিণী। তিতলি শব্দটার বাংলায় কোনো আলাদা অর্থ হয় কিনা ঠিক জানি না, হিন্দিতে মানে হল গিয়ে প্রজাপতি। তবে সেই বলে না 'কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন' কিংবা 'হাড় চামারের নাম কৃপাসিন্ধু'; এটা বোধহয় তার সার্থক উদাহরণ। আমার বৌয়ের নামটা যতই মিষ্টি হোক, প্রজাপতি যতই ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াক, জন্মের পর এর মুখে কেউ নিশ্চয়ই ক্ষুর ছুঁইয়ে দিয়েছিল। একবার রেগে গিয়ে মুখ খুললেই মনে হয় যেন গায়ে চাবুক পড়ছে। বাক্যবাণে ফালাফালা করে দেয়। আজও সেই দশা।
তাও পরিবেশ একটু লঘু করার জন্য বললাম, "তুমি রাগলে না হেব্বি দেখায় মাইরি। নতুন করে প্রেমে পড়ে যেতে ইচ্ছে হয়।"
কিন্তু কপালে শনি নাচছিল সেটা সকালে উঠে খবরের কাগজ তুলতে গিয়ে যখন পাশের ফ্ল্যাটের ঝুনিবৌদিকে দেখি, তখনই বুঝেছিলাম। ঝুনিবৌদির সুনাম আছে পুরো কমপ্লেক্সে সবচেয়ে ঝগড়ুটে মহিলা বলে আর তার সাথে যে তিনি আমার জন্য অপয়া সেটাও বুঝি মাস দুয়েক আগে।
এক শীতের সকালে ছটার দিকে একনাগাড়ে তিনচারবার ডোরবেল ঘুমটা চটকে দিয়েছিল। পাশ ফিরে তিতলিকে হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে বলি 'দেখো না কে এলো'। কিন্তু প্রত্যুত্তরে আমার ঘুমকাতুরে স্ত্রী-এর একটা অস্পষ্ট গোঙানি শুনে বুঝলাম আমাকেই উঠতে হবে। দরজা খুলে দেখি ঝুনিবৌদি।
"ভাই বড় বিপদে পড়ে গেছি। আমার ইয়ের, মানে তোমাদের সমরদার আজ সকালের ফ্লাইটে দিল্লি যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার সকালে ফোন করে বলছে পেট খারাপ, আসতে পারবে না। আমিও এদিকে গাড়ি চালাতে পারি না। আর এখন ট্যাক্সি কোথায় পাই না পাই। তুমি যদি একটু হেল্প করে দাও ভাই।"
"অবশ্যই, চিন্তা নেই আপনার, আমি রেডি হয়ে পনের মিনিটে নামছি।" মনের সমস্ত বিরক্তি মনে রেখেই বললাম। হাজার হোক মানুষ সামাজিক জীব। আর জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। ঘরে গিয়ে তিতলিকে ডেকে ঘটনাটা বলে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। কমোডে বসে ভাবছিলাম ভ্রাতৃত্ববোধ মানুষের ঠিক দরকারের সময় কেন জেগে ওঠে, এটা নিয়ে যেকোনো সাইকোলজি স্টুডেন্ট একটা রিসার্চ পেপার নামিয়ে দিতে পারবে নিশ্চয়ই। আর একটা আলাদা সেকশন বাঙালিদের জন্য রাখা উচিত তাতে।
পঁচিশ মিনিট পর গাড়িতে সমরদাকে নিয়ে যখন কমপ্লেক্স থেকে রাস্তায় বেরোলাম তখনও বুঝিনি খারাপ দিনের ওই শুরু। এয়ারপোর্ট গিয়ে ওকে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় রাস্তায় হঠাৎ একটা বিশাল আওয়াজ। নিমেষে বুঝলাম টায়ারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হলো। আর এক লহমায় মনে পড়ল গাড়িতে স্পেয়ার নেই। ব্যস, সারাদিনের জন্য ভোগার সেই শুরু। সেই দিনে আমার অফিস যাওয়া হয়নি, গলদঘর্ম হতে হয়েছে গাড়ি নিয়ে, বেশ কিছু টাকা ধ্বসেছে আর গোদের ওপর বিষফোড়ার মত যখন শেষমেষ অভুক্ত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছলাম তখন দেখলাম, আমার মাননীয়া স্ত্রীর অফিস থেকে জরুরি ফোন আসায় অনেক সকালে বেরিয়ে যেতে হয়েছে আর বাড়িতে কিচ্ছুটি রান্না করা নেই। বাকি দুঃখের কথা শুনিয়ে আর কি লাভ! মোটের ওপর, সেদিনই বুঝে গেছি যে সকালে উঠে আর যাই করি, ডোরবেল শুনে কিছুতেই দরজা খুলতে যাওয়া যাবে না। আর ঝুনিবৌদির মুখদর্শন পারতপক্ষে সকালের দিকে না করাই ভালো।
কিন্তু সব তো আর ইচ্ছেমত হয় না। হলে তো সবার আগে বৌটিকে পরিণীতি চোপড়া দিয়ে বদলে নিতাম। ওরম একখানা বৌ পেলে শত মুখঝামটা দিলেও সয়ে যাবে।
আজও ঝুনিবৌদি যথারীতি নিজের প্রভাব দেখিয়ে দিলেন। রূপের প্রশংসায় ভবি ভুলল না। কড়া সুরে মহিয়সী বলে উঠলেন, "মাখন লাগাতে যেও না। লাভ নেই। হবে না যখন বলেছি, হবে না। আর এখন আমার সামনে থেকো না। ভালো চাও তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।"
আর কি করি! কাঁচুমাঁচু মুখে বেরিয়ে হাঁটা লাগলাম ক্লাবটার দিকে। জিজোর এখন ওখানেই থাকার কথা। কমপ্লেক্সের ভেতরেই এই ক্লাব। তাস, দাবা, বিলিয়ার্ড, টেবল টেনিস খেলার জন্য। বাইরেই ব্যাডমিন্টন আর টেনিস খেলার জায়গা আর একপাশে সুইমিং পুল। ভেবেছিলাম এই রোববারের সকালে এখন আর কাউকেই পাওয়া যাবে না। গিয়ে দেখলাম ভুল ভেবেছিলাম, দুনিয়ায় বৌয়ে-তাড়ানো-পুরুষ আরও বেশ কিছু আছে। একপাশে সোফায় বসে শাশ্বতদা আর জিজো দাবা খেলছিল। ওদের পাশে গিয়ে ধপাস করে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বললাম, "শালা পুরো দুনিয়াটাই একটা প্রহসন।"
জিজো একগাল হেসে বলল, "বৌ রাজি হয়নি তো?"
আমায় মাথা নাড়তে দেখে আরও চওড়া হাসি দিল, "এইজন্য আজও বিয়ে করিনি। আর তোমাদের দেখে সত্যিই কষ্ট হয়। কি করে এখনো যে নিজেদের পুরুষ মানুষ বল! তোমার মত ছেলে, যে র্যাগিং করতে এলে জুনিয়ররা অনেক সময়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত তাকে কিনা এখন বৌয়ের কথায় উঠতে বসতে হচ্ছে। ভাবলেই কিরকম একটা লাগে।"
পরবর্তী আধ ঘণ্টায় জিজো আমাকে বুঝিয়ে দিল যে আমি শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলাম। পুরুষত্ব দেখানোর এই সময়। তাও পুরোপুরি সাহস হচ্ছিল না, কিন্তু যেই মুহূর্তে ও বলল "তোমাদের মত লোকেদের জন্যই স্ত্রৈণ কথাটা আবিষ্কার হয়েছিল", আর থাকতে পারলাম না। ওই একটা শব্দ বড় বেশি অপমানজনক লাগে আমার। ভেতর থেকে একটা সিংহ গর্জন করে উঠলো যেন। এক লহমায় ফোনটা বের করে ডায়াল করলাম তিতলিকে।
কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ধরল, "উফ কি হলো আবার? সবে চিংড়ির মালাইকারিটা বসাব, তখন ফোন করলে! জলদি বল।"
"বেশি কিছু বলার নেই, শুধু এটুকুই বলার জন্য ফোন করলাম যে সবকিছু তোমার ইচ্ছেয় হবে না। অনেকদিন ধরে মেনে নিয়েছি তোমার সবকিছু, কিন্তু আমিও পুরুষমানুষ!"
"এদ্দিনে বুঝলে?" মৃদু হেসে বলল তিতলি, "যাকগে, আবার সেই প্রসঙ্গ তুলছ তো?"
"হ্যাঁ, আর আমি যখন ঠিক করেছি, তখন এটা হবেই।"
আর কিছু বলার আগেই শুনলাম, "বেশ, আর তাহলে বাড়ি ফিরতে হবে না। ক্লাবে বসে গুলতানি কর, আর যা যা মনের ইচ্ছে সব একে একে পূরণ কর। বাড়িতে আর যেন ফেরার ইচ্ছে না হয়। আমি মালাইকারি রাঁধতে গেলাম। যদি একবারও ফেরার ইচ্ছে হয় তাহলে আমি যা বলেছি তাই হবে।"
হতভম্ব অবস্থায় ফোনটা কেটে যেতে শুনলাম। কি আর করি, দুঃখী চোখে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম, "নিজের ইচ্ছে তো বিসর্জন দিতেই হচ্ছে। আর একবারও এ কথা তুললে মালাইকারিটাও যাবে আজ। হবে না কিছু আর আমার। তোদের সেই র্যাগিং করা দুর্দান্ত সিনিয়র মারা গেছে রে জিজো।"
শাশ্বতদা এতক্ষণে মুখ খুলল, "হে হে, এইসব আজকালকার ছেলেপুলের কথায় তুমি বৌ সামলাতে চাও? হাইট অফ হোপ ভাই।"
"তো আপনি কিছু বলুন।" কাতরস্বরে অনুরোধ করলাম।
"শোনো তবে, একটা পুরনো কিন্তু কাজের আইডিয়া দিচ্ছি। সবসময় মনে রাখবে, ওল্ড ইজ গোল্ড", জম্পেশ ভূমিকা করে শুরু করলো শাশ্বতদা, "একটা ভালো কিছু গিফট কিনে নাও। যা তোমার বৌয়ের পছন্দ। আগেকার দিন হলে গয়না সবচেয়ে ভালো কাজ দিত। কিন্তু এটা তুমিই ভালো বুঝবে। যাই হোক, কিনে ঘরে চলে যাও। খাওয়াদাওয়া কর, দেন সবকিছু মিটলে বিকেলের দিকে আস্তে আস্তে গিফট দিয়ে রাজি করিয়ে ফেল। কি, সুন্দর প্ল্যান কিনা?"
"শুনে তো ভালোই মনে হচ্ছে। দেখা যাক কাজ করে কিনা!" ব্যাজার মুখে বলে ঘড়ির দিকে চাইলাম, "তাহলে আমি এখন বেরোই। কিছু একটা কিনি গিয়ে। পরে দেখা হবে বিকেলে।"
শাশ্বতদা হাত নেড়ে "গুড লাক" বলে বিদায় জানালো। জিজোও বুড়ো আঙুল তুলে ধরল।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। কিছুটা দূরে একটা গিফট শপ আছে। সেখান থেকেই কিছু একটা কিনে আনি। পনের মিনিটে পৌঁছে গেলাম সেখানে। তার পরের অংশটা অনেক বেশি জটিল। প্রায় চল্লিশ মিনিট খোঁজার পর অবশেষে একটা বেশ সুন্দর শো-পিস পেলাম, যেটা দেখে মনে হলো তিতলি খুশি হবে। তার সাথে ফেরার পথে ওর প্রিয় রাবড়িও কিনে নিলাম। এইসব করে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল বাড়ি পৌঁছতে।
ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই রান্নাঘর থেকে সুবাস পেলাম একটা। বুঝলাম আজ ঝগড়া করলে বাজে মিস করতাম। বেশি দেরী না করে স্নান সেরে এসে বাধ্য ছেলের, থুড়ি, স্বামীর মত খাওয়ার টেবিলে বসে পড়লাম। আমার বৌয়ের যতই চাঁচাছোলা গলা হোক না কেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, রান্নাটা বেশ ভালো জানে। দুপুরের খাওয়াটা দুর্দান্ত জমেছিল। ইলিশ মাছের কাঁটা দিয়ে কচুশাক, মুগডাল, বেগুনভাজা, চিংড়ি মালাইকারি আর শেষপাতে তখনকার আনা রাবড়ি। আহ, অমৃত!
খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে গিয়ে বিছানার ওপর গিফটটা সাজিয়ে রেখে লম্বা হলাম অন্যপাশে। এইবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা কতক্ষণে ঘরে আসে সে। তারপর বোঝা যাবে শাশ্বতদার অভিজ্ঞতার দৌড় কতখানি। সময় কাটানোর জন্য হাত বাড়িয়ে একটা অস্কার ওয়াইল্ড-এর বই নিয়ে পড়া শুরু করলাম। এক পাতা পড়া হতে না হতেই ঘরে এসে ঢুকলো তিতলি।
"আরিব্বাস! এটা কি?" চোখ দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মারাত্মক খুশি হয়েছে মেয়ে। একটু হেসে বললাম, "তোমার পছন্দ হবে মনে হলো, তাই নিয়ে এলাম।"
"দারুণ! থ্যাঙ্ক ইউ," মিষ্টি হাসলো তিতলি।
এই সুযোগ! মনে মনে শাশ্বতদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে জানাতে বলে উঠলাম, "তাছাড়া সকালে ওরকম ঝগড়া হল, তাই ভাবলাম তোমায় একটু সারপ্রাইজ দিই।"
দু মিনিটের ব্যাপার। পুরো স্ক্রিপ্টটা চোখের পলকে বদলে গেল। তীক্ষ্ণস্বরে বলল ও, "ওহ, বুঝেছি! এটা তা হলে ঘুষ?" বেগতিক বুঝে 'না না' বলতে গেলাম, কিন্তু যা বিপদ হওয়ার হয়ে গেছে। যেন দৈববাণী হলো, "যতই যা কর, ও ইচ্ছে তোমার সফল হবে না!"
ভেবেছিলাম গিফটটাকেও হয়তো ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তবে আধুনিক মেয়ে তো! প্রখর বাস্তবজ্ঞান। গিফটটা সাজিয়ে রাখতে উঠে গেল। আমি ব্যাজার হয়ে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। পুরো মুডটাই খিঁচড়ে গেছে। বাইরের ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে বসে গল্পের বইটাই পড়া শুরু করলাম।
"বেরিয়ে যাও, যেখানে ইচ্ছে যাও। খালি আমাকে আর জ্বালিও না। তোমার কেনা দাসী পাওনি যে যা চাইবে তাই হবে।" সজোরে মুখঝামটা দিয়ে বলে উঠল তিতলি। আমার সহধর্মিণী। তিতলি শব্দটার বাংলায় কোনো আলাদা অর্থ হয় কিনা ঠিক জানি না, হিন্দিতে মানে হল গিয়ে প্রজাপতি। তবে সেই বলে না 'কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন' কিংবা 'হাড় চামারের নাম কৃপাসিন্ধু'; এটা বোধহয় তার সার্থক উদাহরণ। আমার বৌয়ের নামটা যতই মিষ্টি হোক, প্রজাপতি যতই ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াক, জন্মের পর এর মুখে কেউ নিশ্চয়ই ক্ষুর ছুঁইয়ে দিয়েছিল। একবার রেগে গিয়ে মুখ খুললেই মনে হয় যেন গায়ে চাবুক পড়ছে। বাক্যবাণে ফালাফালা করে দেয়। আজও সেই দশা।
তাও পরিবেশ একটু লঘু করার জন্য বললাম, "তুমি রাগলে না হেব্বি দেখায় মাইরি। নতুন করে প্রেমে পড়ে যেতে ইচ্ছে হয়।"
কিন্তু কপালে শনি নাচছিল সেটা সকালে উঠে খবরের কাগজ তুলতে গিয়ে যখন পাশের ফ্ল্যাটের ঝুনিবৌদিকে দেখি, তখনই বুঝেছিলাম। ঝুনিবৌদির সুনাম আছে পুরো কমপ্লেক্সে সবচেয়ে ঝগড়ুটে মহিলা বলে আর তার সাথে যে তিনি আমার জন্য অপয়া সেটাও বুঝি মাস দুয়েক আগে।
এক শীতের সকালে ছটার দিকে একনাগাড়ে তিনচারবার ডোরবেল ঘুমটা চটকে দিয়েছিল। পাশ ফিরে তিতলিকে হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে বলি 'দেখো না কে এলো'। কিন্তু প্রত্যুত্তরে আমার ঘুমকাতুরে স্ত্রী-এর একটা অস্পষ্ট গোঙানি শুনে বুঝলাম আমাকেই উঠতে হবে। দরজা খুলে দেখি ঝুনিবৌদি।
"ভাই বড় বিপদে পড়ে গেছি। আমার ইয়ের, মানে তোমাদের সমরদার আজ সকালের ফ্লাইটে দিল্লি যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার সকালে ফোন করে বলছে পেট খারাপ, আসতে পারবে না। আমিও এদিকে গাড়ি চালাতে পারি না। আর এখন ট্যাক্সি কোথায় পাই না পাই। তুমি যদি একটু হেল্প করে দাও ভাই।"
"অবশ্যই, চিন্তা নেই আপনার, আমি রেডি হয়ে পনের মিনিটে নামছি।" মনের সমস্ত বিরক্তি মনে রেখেই বললাম। হাজার হোক মানুষ সামাজিক জীব। আর জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। ঘরে গিয়ে তিতলিকে ডেকে ঘটনাটা বলে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। কমোডে বসে ভাবছিলাম ভ্রাতৃত্ববোধ মানুষের ঠিক দরকারের সময় কেন জেগে ওঠে, এটা নিয়ে যেকোনো সাইকোলজি স্টুডেন্ট একটা রিসার্চ পেপার নামিয়ে দিতে পারবে নিশ্চয়ই। আর একটা আলাদা সেকশন বাঙালিদের জন্য রাখা উচিত তাতে।
পঁচিশ মিনিট পর গাড়িতে সমরদাকে নিয়ে যখন কমপ্লেক্স থেকে রাস্তায় বেরোলাম তখনও বুঝিনি খারাপ দিনের ওই শুরু। এয়ারপোর্ট গিয়ে ওকে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় রাস্তায় হঠাৎ একটা বিশাল আওয়াজ। নিমেষে বুঝলাম টায়ারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হলো। আর এক লহমায় মনে পড়ল গাড়িতে স্পেয়ার নেই। ব্যস, সারাদিনের জন্য ভোগার সেই শুরু। সেই দিনে আমার অফিস যাওয়া হয়নি, গলদঘর্ম হতে হয়েছে গাড়ি নিয়ে, বেশ কিছু টাকা ধ্বসেছে আর গোদের ওপর বিষফোড়ার মত যখন শেষমেষ অভুক্ত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছলাম তখন দেখলাম, আমার মাননীয়া স্ত্রীর অফিস থেকে জরুরি ফোন আসায় অনেক সকালে বেরিয়ে যেতে হয়েছে আর বাড়িতে কিচ্ছুটি রান্না করা নেই। বাকি দুঃখের কথা শুনিয়ে আর কি লাভ! মোটের ওপর, সেদিনই বুঝে গেছি যে সকালে উঠে আর যাই করি, ডোরবেল শুনে কিছুতেই দরজা খুলতে যাওয়া যাবে না। আর ঝুনিবৌদির মুখদর্শন পারতপক্ষে সকালের দিকে না করাই ভালো।
কিন্তু সব তো আর ইচ্ছেমত হয় না। হলে তো সবার আগে বৌটিকে পরিণীতি চোপড়া দিয়ে বদলে নিতাম। ওরম একখানা বৌ পেলে শত মুখঝামটা দিলেও সয়ে যাবে।
আজও ঝুনিবৌদি যথারীতি নিজের প্রভাব দেখিয়ে দিলেন। রূপের প্রশংসায় ভবি ভুলল না। কড়া সুরে মহিয়সী বলে উঠলেন, "মাখন লাগাতে যেও না। লাভ নেই। হবে না যখন বলেছি, হবে না। আর এখন আমার সামনে থেকো না। ভালো চাও তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।"
আর কি করি! কাঁচুমাঁচু মুখে বেরিয়ে হাঁটা লাগলাম ক্লাবটার দিকে। জিজোর এখন ওখানেই থাকার কথা। কমপ্লেক্সের ভেতরেই এই ক্লাব। তাস, দাবা, বিলিয়ার্ড, টেবল টেনিস খেলার জন্য। বাইরেই ব্যাডমিন্টন আর টেনিস খেলার জায়গা আর একপাশে সুইমিং পুল। ভেবেছিলাম এই রোববারের সকালে এখন আর কাউকেই পাওয়া যাবে না। গিয়ে দেখলাম ভুল ভেবেছিলাম, দুনিয়ায় বৌয়ে-তাড়ানো-পুরুষ আরও বেশ কিছু আছে। একপাশে সোফায় বসে শাশ্বতদা আর জিজো দাবা খেলছিল। ওদের পাশে গিয়ে ধপাস করে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বললাম, "শালা পুরো দুনিয়াটাই একটা প্রহসন।"
জিজো একগাল হেসে বলল, "বৌ রাজি হয়নি তো?"
আমায় মাথা নাড়তে দেখে আরও চওড়া হাসি দিল, "এইজন্য আজও বিয়ে করিনি। আর তোমাদের দেখে সত্যিই কষ্ট হয়। কি করে এখনো যে নিজেদের পুরুষ মানুষ বল! তোমার মত ছেলে, যে র্যাগিং করতে এলে জুনিয়ররা অনেক সময়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত তাকে কিনা এখন বৌয়ের কথায় উঠতে বসতে হচ্ছে। ভাবলেই কিরকম একটা লাগে।"
পরবর্তী আধ ঘণ্টায় জিজো আমাকে বুঝিয়ে দিল যে আমি শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলাম। পুরুষত্ব দেখানোর এই সময়। তাও পুরোপুরি সাহস হচ্ছিল না, কিন্তু যেই মুহূর্তে ও বলল "তোমাদের মত লোকেদের জন্যই স্ত্রৈণ কথাটা আবিষ্কার হয়েছিল", আর থাকতে পারলাম না। ওই একটা শব্দ বড় বেশি অপমানজনক লাগে আমার। ভেতর থেকে একটা সিংহ গর্জন করে উঠলো যেন। এক লহমায় ফোনটা বের করে ডায়াল করলাম তিতলিকে।
কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ধরল, "উফ কি হলো আবার? সবে চিংড়ির মালাইকারিটা বসাব, তখন ফোন করলে! জলদি বল।"
"বেশি কিছু বলার নেই, শুধু এটুকুই বলার জন্য ফোন করলাম যে সবকিছু তোমার ইচ্ছেয় হবে না। অনেকদিন ধরে মেনে নিয়েছি তোমার সবকিছু, কিন্তু আমিও পুরুষমানুষ!"
"এদ্দিনে বুঝলে?" মৃদু হেসে বলল তিতলি, "যাকগে, আবার সেই প্রসঙ্গ তুলছ তো?"
"হ্যাঁ, আর আমি যখন ঠিক করেছি, তখন এটা হবেই।"
আর কিছু বলার আগেই শুনলাম, "বেশ, আর তাহলে বাড়ি ফিরতে হবে না। ক্লাবে বসে গুলতানি কর, আর যা যা মনের ইচ্ছে সব একে একে পূরণ কর। বাড়িতে আর যেন ফেরার ইচ্ছে না হয়। আমি মালাইকারি রাঁধতে গেলাম। যদি একবারও ফেরার ইচ্ছে হয় তাহলে আমি যা বলেছি তাই হবে।"
হতভম্ব অবস্থায় ফোনটা কেটে যেতে শুনলাম। কি আর করি, দুঃখী চোখে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম, "নিজের ইচ্ছে তো বিসর্জন দিতেই হচ্ছে। আর একবারও এ কথা তুললে মালাইকারিটাও যাবে আজ। হবে না কিছু আর আমার। তোদের সেই র্যাগিং করা দুর্দান্ত সিনিয়র মারা গেছে রে জিজো।"
শাশ্বতদা এতক্ষণে মুখ খুলল, "হে হে, এইসব আজকালকার ছেলেপুলের কথায় তুমি বৌ সামলাতে চাও? হাইট অফ হোপ ভাই।"
"তো আপনি কিছু বলুন।" কাতরস্বরে অনুরোধ করলাম।
"শোনো তবে, একটা পুরনো কিন্তু কাজের আইডিয়া দিচ্ছি। সবসময় মনে রাখবে, ওল্ড ইজ গোল্ড", জম্পেশ ভূমিকা করে শুরু করলো শাশ্বতদা, "একটা ভালো কিছু গিফট কিনে নাও। যা তোমার বৌয়ের পছন্দ। আগেকার দিন হলে গয়না সবচেয়ে ভালো কাজ দিত। কিন্তু এটা তুমিই ভালো বুঝবে। যাই হোক, কিনে ঘরে চলে যাও। খাওয়াদাওয়া কর, দেন সবকিছু মিটলে বিকেলের দিকে আস্তে আস্তে গিফট দিয়ে রাজি করিয়ে ফেল। কি, সুন্দর প্ল্যান কিনা?"
"শুনে তো ভালোই মনে হচ্ছে। দেখা যাক কাজ করে কিনা!" ব্যাজার মুখে বলে ঘড়ির দিকে চাইলাম, "তাহলে আমি এখন বেরোই। কিছু একটা কিনি গিয়ে। পরে দেখা হবে বিকেলে।"
শাশ্বতদা হাত নেড়ে "গুড লাক" বলে বিদায় জানালো। জিজোও বুড়ো আঙুল তুলে ধরল।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। কিছুটা দূরে একটা গিফট শপ আছে। সেখান থেকেই কিছু একটা কিনে আনি। পনের মিনিটে পৌঁছে গেলাম সেখানে। তার পরের অংশটা অনেক বেশি জটিল। প্রায় চল্লিশ মিনিট খোঁজার পর অবশেষে একটা বেশ সুন্দর শো-পিস পেলাম, যেটা দেখে মনে হলো তিতলি খুশি হবে। তার সাথে ফেরার পথে ওর প্রিয় রাবড়িও কিনে নিলাম। এইসব করে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল বাড়ি পৌঁছতে।
ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই রান্নাঘর থেকে সুবাস পেলাম একটা। বুঝলাম আজ ঝগড়া করলে বাজে মিস করতাম। বেশি দেরী না করে স্নান সেরে এসে বাধ্য ছেলের, থুড়ি, স্বামীর মত খাওয়ার টেবিলে বসে পড়লাম। আমার বৌয়ের যতই চাঁচাছোলা গলা হোক না কেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, রান্নাটা বেশ ভালো জানে। দুপুরের খাওয়াটা দুর্দান্ত জমেছিল। ইলিশ মাছের কাঁটা দিয়ে কচুশাক, মুগডাল, বেগুনভাজা, চিংড়ি মালাইকারি আর শেষপাতে তখনকার আনা রাবড়ি। আহ, অমৃত!
খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে গিয়ে বিছানার ওপর গিফটটা সাজিয়ে রেখে লম্বা হলাম অন্যপাশে। এইবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা কতক্ষণে ঘরে আসে সে। তারপর বোঝা যাবে শাশ্বতদার অভিজ্ঞতার দৌড় কতখানি। সময় কাটানোর জন্য হাত বাড়িয়ে একটা অস্কার ওয়াইল্ড-এর বই নিয়ে পড়া শুরু করলাম। এক পাতা পড়া হতে না হতেই ঘরে এসে ঢুকলো তিতলি।
"আরিব্বাস! এটা কি?" চোখ দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মারাত্মক খুশি হয়েছে মেয়ে। একটু হেসে বললাম, "তোমার পছন্দ হবে মনে হলো, তাই নিয়ে এলাম।"
"দারুণ! থ্যাঙ্ক ইউ," মিষ্টি হাসলো তিতলি।
এই সুযোগ! মনে মনে শাশ্বতদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে জানাতে বলে উঠলাম, "তাছাড়া সকালে ওরকম ঝগড়া হল, তাই ভাবলাম তোমায় একটু সারপ্রাইজ দিই।"
দু মিনিটের ব্যাপার। পুরো স্ক্রিপ্টটা চোখের পলকে বদলে গেল। তীক্ষ্ণস্বরে বলল ও, "ওহ, বুঝেছি! এটা তা হলে ঘুষ?" বেগতিক বুঝে 'না না' বলতে গেলাম, কিন্তু যা বিপদ হওয়ার হয়ে গেছে। যেন দৈববাণী হলো, "যতই যা কর, ও ইচ্ছে তোমার সফল হবে না!"
ভেবেছিলাম গিফটটাকেও হয়তো ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তবে আধুনিক মেয়ে তো! প্রখর বাস্তবজ্ঞান। গিফটটা সাজিয়ে রাখতে উঠে গেল। আমি ব্যাজার হয়ে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। পুরো মুডটাই খিঁচড়ে গেছে। বাইরের ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে বসে গল্পের বইটাই পড়া শুরু করলাম।
আর সেইখানেই এই ঘটনার পুরো মোড় ঘুরে গেল। বলে না, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়? নিজেকে বহুদিন পর ভাগ্যবান মনে হল। ভাগ্যিস ওই অস্কার ওয়াইল্ড নিয়েছিলাম পড়ার জন্য। বইটার নাম The Importance of Being Earnest। পড়তে পড়তে হঠাৎ একটা লাইনে চোখটা আটকে গেল। উনি বলছেন, "All women become like their mothers. That is their tragedy."
ওটা পড়েই আমার শাশুড়িমায়ের কথা মনে পড়ে গেল। তিতলি আমার ওপর যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, মায়ের ভীষণ বাধ্য মেয়ে আর খুবই সৌভাগ্যক্রমে উনি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। সেটাকেই হাতিয়ার করে ওনাকে পটিয়ে ফেলতে পারলে আর চিন্তা নেই। মেয়েকে বোঝানোর দায়িত্ব তারপর ওর আর অচিরেই যুদ্ধজয়ের গৌরব আমার। সত্যিই ট্র্যাজিক হবে বেচারীর জন্য। সম্ভাবনাটার কথা ভেবেই আনন্দ হতে শুরু করলো মনের মধ্যে।
আর বেশি দেরী না করে ফোন করে ফেললাম। কুশল সংবাদ নিতে যেটুকু সময় যায়, তারপরই খোলসা করে সবটা বোঝালাম ভদ্রমহিলাকে। বলা বাহুল্য, জামাই-প্রীতি এতটাই বেশি যে উনি বললেন, "আচ্ছা আমি বিকেলে আসছি তোমাদের বাড়িতে। ওকে বুঝিয়ে বলব। তবে এখনই ওকে বোলো না যে আমি আসব। তুমি ততক্ষণ আর নতুন করে ঝামেলা কোরো না।"
পাগল! আর কেউ ঝামেলা করে! এইবারেই তো জমবে খেলা।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় বেজে উঠল ডোরবেলটা। মনের উত্তেজনা চেপে রেখে বসে বসে দেখলাম তিতলি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। ঘরে এসে ঢুকল আমার আজকের প্রধান অস্ত্র। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আমার দিকে ঘুরে বললেন, "কি গো, কেমন আছ? সব খবর ভালো তো? হঠাৎ করেই কিছু না বলে এসে পড়লাম।"
শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম, "আরে না না, তাতে কি হয়েছে? বসুন বসুন।"
ভদ্রমহিলা নাটক করলে নিশ্চয়ই প্রচুর নাম করতেন। আমাদের দু'জনের দিকে একবার করে চেয়ে দেখে মেয়েকে বললেন, "কি ব্যাপার রে? তোদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?"
"কেন?" উত্তর দিল তিতলি। চোখে সন্দেহের ছাপ। আমারও মনে হল একটু কাঁচা হয়ে গেল বোধহয়। কিন্তু না, অভিজ্ঞতার আর সেন্টুর দামই আলাদা। হালকা হেসে বললেন উনি, "তোর মা রে আমি, দেখে যদি নাই বুঝলাম তাহলে আর কি করে হবে! কি হয়েছে বল।"
শতকোটি নমস্কার জানালাম মনে মনে। বিশ্বাস দৃঢ় হল ওনার ক্ষমতার ওপর। ইতিমধ্যে তিতলি সাতকাহন করে শুরু করেছে সবকিছু বলা। আমার ইচ্ছেটা কতটা অযৌক্তিক, এতে করে আমাদের মধ্যে অনেক দূরত্ব চলে আসবে, টাকার বেকার শ্রাদ্ধ - অভিযোগের ফিরিস্তি মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। সবকিছু শেষ হলে পক্ককেশ শাশুড়ি শুরু করলেন, "দ্যাখ তিতলি, একটা পুরুষমানুষের অনেকরকমের চাহিদা থাকে রে। সব কি আর তুই মেটাতে পারবি বল?"
দু'জনেই আমার দিকে একটা চোরা চাউনি দিল দেখে আমি বুঝলাম আমার এখন এ ঘরে থাকা উচিত নয়। আবার গিয়ে ব্যালকনিতে বসলাম।
কি বোঝালেন ভদ্রমহিলা জানি না, মিনিট পনের পরে তিতলি এসে আমাকে বলল, "আচ্ছা যাও শখ মেটাও নিজের। কিন্তু বেশি সময় নষ্ট যেন না হয়!"
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পাক্কা একটা গোটা মিনিট লেগেছিল। তারপরই 'ইউরেকা' বলে একটা পেল্লাই লাফ মেরে ছুটে গিয়ে ল্যাপটপ খুললাম। নিজেকে কেমন যেন শাহেনশা মনে হচ্ছিল। ঠিক সাত সেকেণ্ডে গুগল খুলে টাইপ করতে শুরু করলাম, "online order FIFA 2015"...
বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় বেজে উঠল ডোরবেলটা। মনের উত্তেজনা চেপে রেখে বসে বসে দেখলাম তিতলি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। ঘরে এসে ঢুকল আমার আজকের প্রধান অস্ত্র। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আমার দিকে ঘুরে বললেন, "কি গো, কেমন আছ? সব খবর ভালো তো? হঠাৎ করেই কিছু না বলে এসে পড়লাম।"
শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম, "আরে না না, তাতে কি হয়েছে? বসুন বসুন।"
ভদ্রমহিলা নাটক করলে নিশ্চয়ই প্রচুর নাম করতেন। আমাদের দু'জনের দিকে একবার করে চেয়ে দেখে মেয়েকে বললেন, "কি ব্যাপার রে? তোদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?"
"কেন?" উত্তর দিল তিতলি। চোখে সন্দেহের ছাপ। আমারও মনে হল একটু কাঁচা হয়ে গেল বোধহয়। কিন্তু না, অভিজ্ঞতার আর সেন্টুর দামই আলাদা। হালকা হেসে বললেন উনি, "তোর মা রে আমি, দেখে যদি নাই বুঝলাম তাহলে আর কি করে হবে! কি হয়েছে বল।"
শতকোটি নমস্কার জানালাম মনে মনে। বিশ্বাস দৃঢ় হল ওনার ক্ষমতার ওপর। ইতিমধ্যে তিতলি সাতকাহন করে শুরু করেছে সবকিছু বলা। আমার ইচ্ছেটা কতটা অযৌক্তিক, এতে করে আমাদের মধ্যে অনেক দূরত্ব চলে আসবে, টাকার বেকার শ্রাদ্ধ - অভিযোগের ফিরিস্তি মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। সবকিছু শেষ হলে পক্ককেশ শাশুড়ি শুরু করলেন, "দ্যাখ তিতলি, একটা পুরুষমানুষের অনেকরকমের চাহিদা থাকে রে। সব কি আর তুই মেটাতে পারবি বল?"
দু'জনেই আমার দিকে একটা চোরা চাউনি দিল দেখে আমি বুঝলাম আমার এখন এ ঘরে থাকা উচিত নয়। আবার গিয়ে ব্যালকনিতে বসলাম।
কি বোঝালেন ভদ্রমহিলা জানি না, মিনিট পনের পরে তিতলি এসে আমাকে বলল, "আচ্ছা যাও শখ মেটাও নিজের। কিন্তু বেশি সময় নষ্ট যেন না হয়!"
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পাক্কা একটা গোটা মিনিট লেগেছিল। তারপরই 'ইউরেকা' বলে একটা পেল্লাই লাফ মেরে ছুটে গিয়ে ল্যাপটপ খুললাম। নিজেকে কেমন যেন শাহেনশা মনে হচ্ছিল। ঠিক সাত সেকেণ্ডে গুগল খুলে টাইপ করতে শুরু করলাম, "online order FIFA 2015"...
Comments
Post a Comment