ফিরে আসা


(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

মিনিট পঁচিশ আগেই সেজমামা ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে হাসপাতালের কাজ মিটে গেছে। শনিবারের বিকেল বলে অনেকেরই ভয় ছিল হয়তো আজ কাউকে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ভাগ্যের জোরেই হোক, কি মামার প্রশাসনিক মহলে বিস্তর চেনাজানার সুবাদেই হোক, ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে পোস্টমর্টেম করে মৃতদেহ রিলিজ করে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে। ফোনে কথা শেষ করে ছোটমামা খবরটা জানাতে মাসিদের পাড়ার সুকান্ত বলে একটু সবজান্তা টাইপের ছেলেটা সেটাই বলেছিল, "লাকি-লি আজই হয়ে গেল সবকিছু। এখন বডি নিয়ে এলেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হবে।" 

শুনে বেশ অদ্ভুত লেগেছিল। মৃত্যুর অব্যবহিত পরই যত নিকট আত্মীয়ই হোক না কেন, বাবা-মা-দাদা-বোন যেই হোক, সব সম্পর্ক মুছে দিয়ে নিজগুণে তারা 'বডি' হয়ে ওঠে। 'ছেলেটাকে কখন শ্মশানে নিয়ে যাবে' না বলে সবাই জিগ্যেস করে 'বডিটা কখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে'। কোনও কোনও শুভাকাঙ্ক্ষী আবার একধাপ এগিয়ে বলেন, 'এইবেলা বেরিয়ে গেলে ভালো, জলদি মিটে যাবে ওদিকে'। 

অবশ্যই! একজন যখন স্বার্থপরের মতন মারা যেতে পেরেছে, তার সবকিছু যত তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেওয়া যায় ততই তো ভালো। কিন্তু 'বডি'টার পোস্টমর্টেম আজ বিকেলেই হয়ে যাওয়াটা কতটা 'লাকি' সেটা তখন ঠিক বুঝতে পারিনি।

ইতিমধ্যে এপাশে ওপাশে চলা টুকরো-টাকরা আলোচনা আর মন্তব্য শুনে এতক্ষণে ছবিটা অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। চাকুরীজীবী মানুষেরা কেউই রোববারের সকালটা শ্মশানে কাটাতে চাইবেন না। রোববারের সকাল মানে ধীরেসুস্থে আটটার দিকে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে বাজারের থলি হাতে বেরনো। এই ভরা ইলিশের মরসুমে একটু তাড়াতাড়ি না পৌঁছলে ছেলের পছন্দের পেটে ডিমওয়ালা ইলিশের পিসগুলো পাওয়া যাবে না। সেখানে দিনটা যদি পাড়ার এক স্বল্পভাষী, অন্তর্মুখী, আত্মঘাতী ছেলের মৃতদেহ দাহ করতে চলে যায়, তাহলে পুরো সপ্তাহটাই হয়তো খারাপ যাবে। তাই আজই এইসব ঝামেলা মিটে যাওয়া ভালো।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না এরা কেন তাও ঘটা করে সমবেদনা জানাতে ছুটে আসে। কেউই এদের কখনও ডাকে না। অথচ বাসি ভাত ছড়ালে যেরকম একরাশ কাকের ভিড় হয়, ঠিক সেইভাবে পাড়ার কোনও বাড়ি থেকে মড়াকান্না ভেসে এলেই এরাও নিমেষে হাজির হয়ে যায়। আর অচিরেই শুরু হয়ে যায় বিনি পয়সার জ্ঞান বিতরণ।

চুপচাপ এককোণে বসে সকলকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। দেখছিলাম মাসি, মা, মামীরা, মৌ সবাই কিভাবে গলা মিলিয়ে কেঁদে চলেছে। মাসতুতো ভাইটাও ভেজা চোখে বসে মাসিকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কান্নাকাটি আমার কোনোকালেই খুব একটা আসে না। মনে হয় কেঁদে তো আর যে চলে গেছে তাকে ফেরত আনা যায় না। ওদের দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলাম আজ আকাশের বদলে আমি মারা গেলে এরা একইরকম ভাবে কাঁদত কিনা। নাকি শুকনো মুখে সবাই শুধু বলত, 'কি যে হয়েছিল কে জানে! কিছুই বুঝতে দিল না আগে থেকে।' 

এইসব সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যেই বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেলাম আর সেই শুভাকাঙ্খী সুকান্তর দল নিমেষে অত্যুদ্সাহে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, 'এই তো চলে এসেছে'। যেটা উহ্য রইল সেটা হলো 'যাক বাবা, এইবার পুড়িয়ে এলেই কাজ শেষ'। বেচারা আকাশ। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার সময় বোধহয় ভাবতেও পারেনি মরে গিয়েও কারো কারো কাছে বোঝাই থেকে যাবে। 

বাবা, কাকা, অন্য মামাতো-মাসতুতো দাদারা একে একে এগিয়ে গেল। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। এখন আবার একপ্রস্থ কান্নাকাটি হবে বুঝতে পারছি। তারপর আস্তে আস্তে ফুল চন্দনে আকাশকে সাজিয়ে সবাই পা বাড়াবে শ্মশানের দিকে। শেষ চিহ্নটুকুও মুছে দিতে। যতক্ষণ না সবাই রওনা দিচ্ছে আমার খুব একটা কিছু করার নেই। এই কান্নাকাটি শুনে আরো বিরক্তি চলে আসে, সবটাই কেমন যেন মেকি মনে হয়। কেউই তো কারো জন্য অপরিহার্য হয় না। সেই বড়কাকু যখন বিয়ের চারমাস পরে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল, কাকিমার কান্না দেখে মনে হয়েছিল সহমরণে যেতেও রাজি। তার এক বছর পর কালঅশৌচ চুকতে না চুকতেই তো দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে আবার বিয়েও করে ফেলল। বা সেই সৌম্যর বাবার যখন হার্ট অ্যাটাক হল। সৌম্য তার পরের দুদিন কিছু খায়নি। আর শ্রাদ্ধের তিনদিন পর নিজে নিয়ে গেছিল আমাদের বিরিয়ানি খাওয়াতে। এমনকি পরদিকে ওকে দেখে তো আমার এরকম মনে হয়েছে যে বাবার মারা যাওয়াতে চাকরি-পেনশন-ইন্সিওরেন্স এসব থেকে যা টাকা পেয়েছে ও বোধহয় খুশিই হয়েছে তাতে। তাই এইসব কান্নাকাটি দেখে নিজের লোকেদের ওপর বিরক্তি জন্মানোর চেয়ে একটু বাইরে গিয়ে ফুসফুসে অত্যাচার চালানো ভালো। দু মাস হল সিগারেট টানা শুরু করেছি। বেশ সুন্দর সময় কেটে যায়। 

খুব সাবধানে সবার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। কিন্তু বিধি বাম। মুখোমুখি পড়ে গেলাম সুমিবৌদির। আমার এক মামাতো দাদার বৌ। কোনো কারণে আমার খোঁজখবর রাখতে বেশ ভালোবাসে। অবশ্য অনেকেই আজকাল মাঝে মাঝে আমার খবর নেয়। মনে হয় একলা নিশ্চিন্তে জীবন কাটাই, সেটা কেউ খুব একটা পছন্দ করে না। তার ওপর আমার পেটপাতলা মায়ের কল্যাণে অনেকেই দু-তিন মাস আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার কথা জানে। বলা বাহুল্য, তারপর থেকে কেউ কথা বলতে এলেই আমার রীতিমত অস্বস্তি হয়। তবু সামাজিকতা বলে একটা জিনিস হয়। তাই সুমিবৌদিকে দেখেও না দেখার ভান করে কেটে পড়তে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, "কখন এলে?"

"অনেকক্ষণ হয়েছে রে। খবরটা শুনেই তো চলে এলাম। তুই কখন এসেছিস? খেয়াল করিনি তো।" আমার সৌভাগ্য বলতে হবে। খেয়াল করলে এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হত না।

"আমি এই আধ ঘন্টা হলো এসেছি। ওই খবরটা যখন আসে, তখন তো বাবা অফিসে। তো বাবা ফিরল, তারপরই আমরা এলাম। যা রাস্তার হাল, এক ঘন্টার রাস্তা প্রায় দু ঘন্টা লেগে গেল।"

খানিকটা স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই একরাশ কথা বলে ফেললাম, এই আশায় যে এইবার টুক করে কেটে পড়তে পারব। তাই বৌদিকে আর কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে বললাম, "আচ্ছা তুমি ভেতরে যাও, আমি একটু হেঁটে আসি।"

প্রত্যাশিত ভাবেই পরের প্রশ্নটা এল, "কোথায় যাবি?"

"এই বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। আর বেরোতে বেরোতে আরো এক ঘন্টা বোধহয় লেগেই যাবে। তাই ভাবলাম একটু মোড় থেকে ঘুরে আসি।"

"চল আমিও যাব। আমারও এখানে এই এত কান্নাকাটি ভালো লাগছে না।" 

প্রবল আপত্তি জানাতে গেলাম ঠিকই কিন্তু সুবিধে হলো না। বরাবরই দেখেছি আমার ভাগ্য আমাকে চিরকাল ধোঁকা দিয়ে এসেছে। তবে একটাই ভালো ব্যাপার হলো বৌদির সামনে ধোঁওয়া টানতে সমস্যা নেই। নিজেই বলল, "তুই স্মোক করা শুরু করেছিস জানি। এখন সে জন্যই যাচ্ছিস তাও বুঝেছি। সেটা নিয়ে ভাবিস না। বাধা দেব না।"

দু'জনে হাঁটা লাগালাম মোড়ের দোকানটার দিকে। আমার কাছে সিগারেট থাকে না। যখন ইচ্ছে হয় কিনে টানি। 

"কি সাংঘাতিক ব্যাপার না!" বলল বৌদি। কি আর উত্তর দেব, চুপ করে হাঁটতে থাকলাম পাশাপাশি। সত্যি কথা বলতে, আমি আকাশকে খুব একটা দোষ দিইনি। মানসিক অশান্তি, সব মুহূর্তে জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা আর বাঁচার কোনো কারণ না থাকলে এটাই বোধহয় একমাত্র পন্থা। আর ছেলেটা বহুদিন ধরেই তো মানসিক রোগের শিকার। হয়তো আসলে বেঁচে গেল।

বৌদি আবার বলে উঠল, "মাসির কথাটা ভেবে কষ্ট হয়। কিভাবে কাটাবে যে এখন বাড়িতে!"

এইবার না বলে পারলাম না, "হুঁ, প্রথমদিকে নিশ্চয়ই খুব খারাপ থাকবে। তবে মানুষ তো অভ্যাসের দাস, আস্তে আস্তে সবই সয়ে যাবে।"

"তুই কি পাগল হয়েছিস! ওই দৃশ্য কোনোদিন মাসির চোখের সামনে থেকে মুছবে না। নিজের ছেলেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে দেখা কেউ কখনো ভুলতে পারে রে?"

দোকান থেকে সিগারেটটা কিনে ধরিয়ে একটা টান দিয়ে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "মানে?" আমি একেবারেই জানতাম না মাসির উপস্থিতিতে ঘটেছে ঘটনাটা। সেটা টের পেয়ে সুমিবৌদি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল দুপুরের ঘটনাটা। 

বেলা তখন দেড়টা হবে। মাসি রান্না করে খেতে ডাকে আকাশকে। খাওয়ার আগে ওষুধ খেতে হয় ছেলেটাকে, অনেক কটা। কিন্তু গতকাল থেকে নাকি একেবারেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। বলে নাকি, 'আমি তো ঠিক হয়ে গেছি। কেন অসুস্থ বানাচ্ছ আমাকে?'  তবু আজ দুপুরে মাসি জোর করে ওষুধ খাওয়ার জন্য। ব্যস, এক কথা-দু কোথায় শুরু হয় প্রচন্ড ঝগড়া। দুর্বল মাসিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় আকাশ। অসহায় মাসি জানালা দিয়ে দেখতে পায় যে ঘরে পড়ে থাকা দড়িটা নিয়ে ঝুলে পড়ল বাইশ বছরের ছেলেটা। প্রাণপণ চিৎকার করা সত্বেও পাড়া-প্রতিবেশী কেউ শুনতে পায়নি। কেউ এগিয়ে আসেনি ওই বিপদে। চোখের সামনে মাসি দেখে তার আদরের ভিতু অসুস্থ ছেলেটার দেহটা নিথর হয়ে গেল।

শুনে একটু শিউরে উঠলাম। সত্যিই ভয়াবহ ঘটনা। কিভাবে জানি না, জীবনে প্রথমবার মনে হলো, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তি বোধহয় আত্মজর মৃতদেহ চোখের সামনে দেখা। এটাও বুঝলাম সন্তানের মৃত্যু কেউই কোনোদিন ভুলতে পারে না, মাসিরও হয়তো বাকি জীবনটা এই দিনটার স্মৃতি নিয়েই কেটে যাবে।

পরিবেশটা একটু হালকা করতে বৌদি বলল, "ছাড় এসব, এখন আর এসব নিয়ে ভাবলে শুধু মনখারাপই হবে। তুই বল। কবে ফিরছিস আবার ও দেশে?" প্রশ্নটা এক লহমায় মনে করিয়ে দিল আমার আগামীকাল বিকেলেই ফ্লাইট। আবার ফিরে যেতে হবে সেই বিদেশ বিভূঁই-এ। ভেতরের বিরক্তি, হতাশা লুকোতে পারলাম না। শুকনো মুখে উত্তর দিলাম, "কাল বিকেলে বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট।"

বৌদির নজর এড়ায়নি আমার চোখের হতাশ দৃষ্টিটা। সান্তনা দেওয়ার সুরে বলল, "চিন্তা করিস না। এই তো আর কটা দিন। দিব্যি কেটে যাবে দেখিস।"

সেই তো। আর কটা দিনই বটে! 'মাত্র' চার বছর আর। যাকগে, এদ্দিনে এসব কথায় হেসে ঘাড় নাড়তে শিখে গেছি। এখনো তাইই করলাম। বেকার কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ হয় না। তাই এই শুকনো হাসিই অনেক ভালো। কে যেন একটা বলেছিল না, পুরো জীবনটাই একটা প্রকান্ড রঙ্গমঞ্চ। আজকাল প্রতি পদে সেটা মনে হয়।

সিগারেটটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। খেয়াল হতে আবার একটা টান দিয়ে পায়ের তলায় ফেলে পিষে দিলাম। এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিল সুমিবৌদি। এবার বলল, "তুই চলে আসতে পারিস না এখানে?"

"মানে? কোথায় চলে আসব?" জিজ্ঞেস করলাম।

"ও দেশে আর পড়ে না থেকে এখানে। বলছি না এই শহরে বাড়িতে থাক। কিন্তু কলকাতা কি ব্যাঙ্গালোর কোথাও নিশ্চয়ই ভালো কিছু করতে পারবি।"

রাগ-দুঃখ-হতাশা একসাথে হলে কিরকম একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। আমারও সেটাই হলো। আজ অবধি জীবনে কোনো কিছু থেকে পিছু হটিনি। গত কয়েক মাস হলো বারবার ঘুরিয়েফিরিয়ে সবাই এটাই বলছে। তবে যতই খারাপ থাকি না কেন, ফেরত আমি আসব না এটা ঠিক করেই নিয়েছি। এক নিমেষে বললাম, "কিসব ফালতু কথা! আমি একদম খারাপ নেই ওখানে। অহেতুক ছেড়ে এখানে আসতে যাব কেন?"

"গাধা!" বকে উঠল বৌদি, "তোরা চিরকাল নিজের কথাই ভেবে যা! তোর জন্য ফিরে আসতে বলিনি। পিসির জন্য বলেছি।" পিসি মানে আমার মা। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম কেন মায়ের জন্য আসতে বলছে।

"গত কয়েক মাস পিসি ঠিক করে ঘুমোতে পারেনি রে। আমরা যখনই তোদের বাড়িতে যেতাম শুধু কাঁদত। আর ঠাকুমাও প্রচন্ড দুঃখ করত। মাঝে মাঝেই বলে উঠত, আর বোধহয় তোর সাথে দেখা হবে না। ছেলেমেয়েকে নিয়ে মানুষের কতটা চিন্তা হয় এখন বুঝবি না। আরো একটু বড় হ।" একটু থেমে বলল, "কিন্তু সিরিয়াসলি একবার ভেবে দেখিস, যদি সম্ভব হয় ফিরে আসিস। তোর মা-বাবা-ঠাকুমা অনেক ভালো থাকবে রে।"

বৌদি আরো অনেক কিছু বলত হয়তো। আর শুনতে ইচ্ছে করলো না। থামিয়ে দিয়ে বললাম, "চল ওখানে। ওরা বেরোবে বোধহয়।"

দু'জনে রওনা দিলাম মাসির বাড়ির দিকে। দূর থেকেই দেখতে পেলাম বাইরেই বাবা আর মা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বাবা বলল, "কোথায় ছিলিস? বলে যাবি তো! আর বারবার ফোন করছি। সেটাও ধরিস না।"

মায়ের দিকে তাকালাম। এতক্ষণ কান্নার জন্য চোখ লাল হয়ে আছে। তবু চোখে একটা অনুক্ত চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। একটা অপরাধবোধ হলো। সত্যিই কখনো বুঝিনি এদের জীবন পুরোটাই আমাকে ঘিরে। আর বেশি না ভেবে বললাম, "বাবা, আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। এখানে আর থেকে কি হবে? ব্যাগটা বরং গুছিয়ে ফেলি গিয়ে। আমি বাসে চলে যাচ্ছি। তোমরা গাড়ি নিয়ে এস পরে।" বলে আর দাঁড়ালাম না। হতবাক বাবা-মাকে পেছনে রেখে পা চালালাম বাস-স্ট্যান্ডের দিকে।

পরের দেড় ঘন্টা মাথার ভেতর একরাশ চিন্তা, অনেক ঘটনা আর বৌদির কথাগুলো সমানে ঘুরপাক খেতে লাগলো। বড্ড স্বার্থপর আমরা সবাই। কখনো ভেবে দেখিনি যে আমি খারাপ থাকলে অন্য দু-তিনটে লোকের দিনও খারাপ যেতে পারে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে বাড়ি পৌঁছলাম। সোজা গিয়ে ঢুকলাম নিজের ঘরে।

ব্যাগের চেনটা খুলে কৌটোটা বের করে তাকিয়ে দেখলাম। চার ঘন্টা আগেও এই একইভাবে বসে ছিলাম। তখনই ফোনে খবরটা পেয়েছিলাম, 'আকাশ গলায় দড়ি দিয়েছে'। কৌটোটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে ছাদে উঠলাম। পরশুই কিনেছি এটা। আগেরবার বারোটায় কাজ না দেওয়ায় এবার পঞ্চাশটা ট্যাবলেট-ওয়ালা এটা কিনেছিলাম। আকাশের খবরটা না এলে এখন আর একটাও পড়ে থাকত না। হয়তো আমিও আর থাকতাম না।

ছাদের রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দু মিনিট ভাবলাম। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সজোরে ছুঁড়ে দিলাম কৌটোটা। বাড়ির পেছনের মাঠের দিকে। অন্ধকারে। এক অজানা উদ্দেশ্যে। যাতে আর ফিরে না আসতে পারে ওটা।

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মাকে ফোন করলাম। "কি রে, পৌঁছে গেছিস?" পরিচিত গলাটা শুনে অনেকদিন পর মনটা আনন্দে ভরে উঠল। একটু চুপ করে থেকে বললাম, "আমি ফিরে আসব।" হতবাক মা কি বলবে না বুঝে চুপ করে রইল। শুধু শুনতে পেলাম একটা দীর্ঘশ্বাস। ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে মায়ের ছবিটার দিকে চেয়ে নিজের মনে আবার বলে উঠলাম, "আমি ফিরে এসেছি মা।"


Comments

Popular posts from this blog

A three-day affair with Mexico City

An African Diary : A marvellous journey inside the Maasai Mara

অভ্যেস