কাল্পনিক
বহুদিন কিছু লেখা হয়না। আসলে জীবনটা বড্ড ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে। আমি আবার
জীবন থেকেই গল্প খুঁজি কিনা। যাই হোক, এটাও একটা সত্যি ঘটনা থেকে নেওয়া।
তবে গল্প না বলে অভিজ্ঞতা বলাই ভালো। আর হ্যাঁ, স্থান না বদলালেও কাল আর
পাত্র একটু বদলে দিলাম।
শনিবারের দুপুর। মানে ওই চারটে মত বাজে বোধহয়। এ পোড়া দেশে তো ছাই
গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যে বলে ব্যাপারটাই উঠে গেছে। সূর্য পশ্চিমের আকাশে ঢলতে
শুরুই করে সেই সাতটার পর। দেশে যখন থাকতুম, ওই সময়টায় খেলাধুলো সেরে ফিরে
আসতে হত বাড়িতে। গোধূলিবেলার আকাশে তখন কোটি কোটি নীড়মুখো পাখিদের ভিড়।
পাড়ার সব বাড়িতে একে একে আলো জ্বলে উঠছে আর ভেসে আসছে একের পর এক শাঁখের
আওয়াজ।
নাহ, বড্ড নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। সেসব দিন যখন ফিরে পাওয়া যাবে না আর, অহেতুক স্মৃতিচারণ করে খুব বেশি লাভ নেই। তার চেয়ে বরং যে গল্পটা, থুড়ি, যে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়া শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই।
হ্যাঁ, এটা গত শনিবারের কথা। দুপুরের খাওয়া সেরে একটা হালকা ঘুম মেরে দিয়ে তিনটের দিকে উঠে মনে হল, এমন সুন্দর বিকেলটা ঘরে বসে কাটানোর মানেই হয় না। কিছু না হলেও একটু খেলতে যাওয়া উচিত। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। একটা এস-এম-এস ছেড়ে দিলাম বন্ধুদের গ্রূপে, আর ব্যাডমিন্টন র্যাকেট কাঁধে নিয়ে হাঁটা লাগালাম ইউনিভার্সিটির জিমের দিকে। কিন্তু তখন বুঝিনি ওই দিনটা এরকম একটা অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করাবে আমাকে।
ঘটনাটা ঘটে খেলা সেরে ফেরার পথে। প্রায় এক ঘণ্টা খেলে এক বন্ধুর সাথে গল্প করতে করতে ফিরছিলাম বাড়ির দিকে। সাধারণত বাসেই ফিরি, ইউনিভার্সিটি আইডি দেখালে ফ্রিতেই হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন বাসস্টপে এসে দেখলাম তখনও পনের মিনিট বাকি পরের বাস আসতে।
গ্রেগ বলল বাসের জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে হেঁটে রওনা দেওয়াই ভালো। অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব। তার চেয়েও বড় কথা, সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। এরকম ওয়েদার শিকাগোতে চট করে পাওয়া যায় না, তাই এই সুযোগ নষ্ট করার মানে নেই। আমিও একবাক্যে মেনে নিলাম।
দুজনে খোশমেজাজে গল্প করতে করতে চলতে শুরু করলাম বাড়ির পথে। আমি বরাবরই হেঁটে ফিরলে অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তাটা ধরি। চুপচাপ গান শুনতে শুনতে যাওয়া যায়। গাড়িঘোড়ার ওই আওয়াজ থেকে একটু দূরে থাকতেই ভালো লাগে আমার।
আজও আমরা ওই রাস্তাতেই হাঁটা লাগালাম। দুজনেই সদ্য হাউস অফ কার্ডস দেখা শুরু করেছি। সেটা নিয়েই আলোচনা চলছিল। হঠাৎ পাশ থেকে 'এক্সকিউজ মি' বলে উঠল একজন।
খানিকটা জড়ানো উচ্চারণ, পরিষ্কার বোঝা যায় ইংরাজি এনার মাতৃভাষা নয়। ঘুরে দেখলাম এক বছর চল্লিশের ভদ্রলোক। চেহারায় মধ্যপ্রাচ্যের একটা ছাপ আছে। গালে হালকা দাড়ি, চুলগুলো উসকোখুসকো, গায়ের রঙ ফর্সা, বেশ শক্তসমর্থ চেহারা। কোনও এক আরবদেশীয় ব্যবসায়ী হবেন হয়তো – এরকম প্রচুর লোকজন আছেন এদেশে।
কিন্তু তাও কেমন যেন একটা রুক্ষ ভাব রয়েছে চেহারায়। দেখে মনে হল গোপন কিছু একটা উদ্দেশ্যেই আমাদের দাঁড় করিয়েছেন।
"ইয়েস?" ইতিমধ্যেই কি দরকার জানতে চেয়েছে গ্রেগ।
ভদ্রলোক জানালেন যে তিনি বেশ বিপদে পড়েছেন। এক বন্ধুর বাড়ি যেতে চান, কিন্তু সাথে কোনও ফোন না থাকায় রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছেন না, এদিকে বন্ধুকে ফোন করে জানাতেও পারছেন না। তো আমরা যদি রাস্তা খুঁজতে সাহায্য করি।
ভাঙা ইংরিজিতে বললেন, "আই উইল বি গ্রেতফুল"।
"নো প্রবলেম", বলে গ্রেগ পকেট থেকে ফোন বের করে জি-পি-এস দেখে ভদ্রলোককে জানিয়ে দিল কিভাবে যেতে হবে তার বন্ধুর বাড়ি।
সবকিছু শুনেটুনে একটু ভুরু কুঁচকে ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন, "আর ইউ শিওর?" আমার দিকে একটা বিরক্তির চাউনি দিয়ে গ্রেগ আবার ফোন বের করে ভালো করে বুঝিয়ে দিল ওনাকে।
এইবার মনে হল বোধহয় পাগল একটু। পুরো রাস্তার নির্দেশ তিনবার ধরে বুঝেও লোকটা কিছুতেই মানতে চাইছে না যে আমরা সত্যিই বলছি। উল্টে প্রচণ্ড চটে যেতে শুরু করল।
এ পাগলের সাথে তর্ক করে আর লাভ নেই বুঝে আমরা দুজনেই একটু পরে বলে উঠলাম যে আমাদের যেতে হবে। বলে উলটোদিকে ফিরে আবার হাঁটা শুরু করব, পেছন থেকে লোকটা ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, "স্তপ।"
ঘুরে দাঁড়ালাম। ধড়াস করে উঠল বুকটা। লোকটার হাতে একটা ছোট কালো রিভলভার। কিছু বলার বা বুঝে ওঠার আগেই আমার দিকে তাক করে গুলি চালিয়ে দিল লোকটা।
প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি বিছানাটা পুরো ঘামে ভিজে গেছে।
বলা বাহুল্য, স্বপ্ন দেখছিলাম। ঘড়িতে তখন সবে সকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে। আস্তে
আস্তে মনে পড়ল সবকিছু।
আগেরদিন রাতে শুতে যাবার ঠিক আগে একটা ই-মেল পেয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটি থেকে সিকিউরিটি অ্যালার্ট। রাত একটার দিকে ক্যাম্পাসের মধ্যে তিনজনকে গুলি করা হয়েছে। কোনও এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি একটা গাড়িতে বসে থাকা দুজন পুরুষ আর একজন মহিলার দিকে আট রাউণ্ড গুলি চালায়। তিনজনের অবস্থাই শোচনীয়। কেন এই গোলাগুলি, তার কারণ কিছু জানা যায়নি।
ঘটনাটার ব্যাপারে জানার পর থেকেই কিছুতেই ঘুম আসছিল না। অনেকবার শুনেছি যে শিকাগো এসব ব্যাপারে বড্ড খারাপ শহর, কিন্তু তাই বলে কখনও ভাবিনি যে ক্যাম্পাসের মধ্যে এরকম কিছু হতে পারে। তাও আবার বিনা কারণে। চারটের দিকে সবে চোখটা একটু লেগে এসেছিল, তখনই এই বিচ্ছিরি স্বপ্ন। এরপর কোনোদিন নিশ্চিন্তে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারব কিনা তাও জানি না।
আর ঘুমোতে পারিনি সেদিন। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার সাথেও যেকোনো দিন এরকম তো হতেই পারে। এ শহরে গুলি করার জন্য কারো কোনও কারণ দরকার হয়না, শুধু একটা রিভলভার দরকার। আর সে তো একরাশ লোকের কাছেই আছে। দেশ উন্নত হলে কি হবে, এখানে বাঁচা বড় কঠিন কাজ।
পুনশ্চঃ স্বপ্নটা কেন দেখেছি, তা তো বুঝেছি, কিন্তু ভদ্রলোকটিকে মধ্যপ্রাচ্যের কেন দেখলাম, তা বুঝতে পারিনি।
***
নাহ, বড্ড নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। সেসব দিন যখন ফিরে পাওয়া যাবে না আর, অহেতুক স্মৃতিচারণ করে খুব বেশি লাভ নেই। তার চেয়ে বরং যে গল্পটা, থুড়ি, যে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়া শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই।
হ্যাঁ, এটা গত শনিবারের কথা। দুপুরের খাওয়া সেরে একটা হালকা ঘুম মেরে দিয়ে তিনটের দিকে উঠে মনে হল, এমন সুন্দর বিকেলটা ঘরে বসে কাটানোর মানেই হয় না। কিছু না হলেও একটু খেলতে যাওয়া উচিত। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। একটা এস-এম-এস ছেড়ে দিলাম বন্ধুদের গ্রূপে, আর ব্যাডমিন্টন র্যাকেট কাঁধে নিয়ে হাঁটা লাগালাম ইউনিভার্সিটির জিমের দিকে। কিন্তু তখন বুঝিনি ওই দিনটা এরকম একটা অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করাবে আমাকে।
ঘটনাটা ঘটে খেলা সেরে ফেরার পথে। প্রায় এক ঘণ্টা খেলে এক বন্ধুর সাথে গল্প করতে করতে ফিরছিলাম বাড়ির দিকে। সাধারণত বাসেই ফিরি, ইউনিভার্সিটি আইডি দেখালে ফ্রিতেই হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন বাসস্টপে এসে দেখলাম তখনও পনের মিনিট বাকি পরের বাস আসতে।
গ্রেগ বলল বাসের জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে হেঁটে রওনা দেওয়াই ভালো। অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব। তার চেয়েও বড় কথা, সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। এরকম ওয়েদার শিকাগোতে চট করে পাওয়া যায় না, তাই এই সুযোগ নষ্ট করার মানে নেই। আমিও একবাক্যে মেনে নিলাম।
দুজনে খোশমেজাজে গল্প করতে করতে চলতে শুরু করলাম বাড়ির পথে। আমি বরাবরই হেঁটে ফিরলে অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তাটা ধরি। চুপচাপ গান শুনতে শুনতে যাওয়া যায়। গাড়িঘোড়ার ওই আওয়াজ থেকে একটু দূরে থাকতেই ভালো লাগে আমার।
আজও আমরা ওই রাস্তাতেই হাঁটা লাগালাম। দুজনেই সদ্য হাউস অফ কার্ডস দেখা শুরু করেছি। সেটা নিয়েই আলোচনা চলছিল। হঠাৎ পাশ থেকে 'এক্সকিউজ মি' বলে উঠল একজন।
খানিকটা জড়ানো উচ্চারণ, পরিষ্কার বোঝা যায় ইংরাজি এনার মাতৃভাষা নয়। ঘুরে দেখলাম এক বছর চল্লিশের ভদ্রলোক। চেহারায় মধ্যপ্রাচ্যের একটা ছাপ আছে। গালে হালকা দাড়ি, চুলগুলো উসকোখুসকো, গায়ের রঙ ফর্সা, বেশ শক্তসমর্থ চেহারা। কোনও এক আরবদেশীয় ব্যবসায়ী হবেন হয়তো – এরকম প্রচুর লোকজন আছেন এদেশে।
কিন্তু তাও কেমন যেন একটা রুক্ষ ভাব রয়েছে চেহারায়। দেখে মনে হল গোপন কিছু একটা উদ্দেশ্যেই আমাদের দাঁড় করিয়েছেন।
"ইয়েস?" ইতিমধ্যেই কি দরকার জানতে চেয়েছে গ্রেগ।
ভদ্রলোক জানালেন যে তিনি বেশ বিপদে পড়েছেন। এক বন্ধুর বাড়ি যেতে চান, কিন্তু সাথে কোনও ফোন না থাকায় রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছেন না, এদিকে বন্ধুকে ফোন করে জানাতেও পারছেন না। তো আমরা যদি রাস্তা খুঁজতে সাহায্য করি।
ভাঙা ইংরিজিতে বললেন, "আই উইল বি গ্রেতফুল"।
"নো প্রবলেম", বলে গ্রেগ পকেট থেকে ফোন বের করে জি-পি-এস দেখে ভদ্রলোককে জানিয়ে দিল কিভাবে যেতে হবে তার বন্ধুর বাড়ি।
সবকিছু শুনেটুনে একটু ভুরু কুঁচকে ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন, "আর ইউ শিওর?" আমার দিকে একটা বিরক্তির চাউনি দিয়ে গ্রেগ আবার ফোন বের করে ভালো করে বুঝিয়ে দিল ওনাকে।
এইবার মনে হল বোধহয় পাগল একটু। পুরো রাস্তার নির্দেশ তিনবার ধরে বুঝেও লোকটা কিছুতেই মানতে চাইছে না যে আমরা সত্যিই বলছি। উল্টে প্রচণ্ড চটে যেতে শুরু করল।
এ পাগলের সাথে তর্ক করে আর লাভ নেই বুঝে আমরা দুজনেই একটু পরে বলে উঠলাম যে আমাদের যেতে হবে। বলে উলটোদিকে ফিরে আবার হাঁটা শুরু করব, পেছন থেকে লোকটা ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, "স্তপ।"
ঘুরে দাঁড়ালাম। ধড়াস করে উঠল বুকটা। লোকটার হাতে একটা ছোট কালো রিভলভার। কিছু বলার বা বুঝে ওঠার আগেই আমার দিকে তাক করে গুলি চালিয়ে দিল লোকটা।
***
আগেরদিন রাতে শুতে যাবার ঠিক আগে একটা ই-মেল পেয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটি থেকে সিকিউরিটি অ্যালার্ট। রাত একটার দিকে ক্যাম্পাসের মধ্যে তিনজনকে গুলি করা হয়েছে। কোনও এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি একটা গাড়িতে বসে থাকা দুজন পুরুষ আর একজন মহিলার দিকে আট রাউণ্ড গুলি চালায়। তিনজনের অবস্থাই শোচনীয়। কেন এই গোলাগুলি, তার কারণ কিছু জানা যায়নি।
ঘটনাটার ব্যাপারে জানার পর থেকেই কিছুতেই ঘুম আসছিল না। অনেকবার শুনেছি যে শিকাগো এসব ব্যাপারে বড্ড খারাপ শহর, কিন্তু তাই বলে কখনও ভাবিনি যে ক্যাম্পাসের মধ্যে এরকম কিছু হতে পারে। তাও আবার বিনা কারণে। চারটের দিকে সবে চোখটা একটু লেগে এসেছিল, তখনই এই বিচ্ছিরি স্বপ্ন। এরপর কোনোদিন নিশ্চিন্তে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারব কিনা তাও জানি না।
আর ঘুমোতে পারিনি সেদিন। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার সাথেও যেকোনো দিন এরকম তো হতেই পারে। এ শহরে গুলি করার জন্য কারো কোনও কারণ দরকার হয়না, শুধু একটা রিভলভার দরকার। আর সে তো একরাশ লোকের কাছেই আছে। দেশ উন্নত হলে কি হবে, এখানে বাঁচা বড় কঠিন কাজ।
পুনশ্চঃ স্বপ্নটা কেন দেখেছি, তা তো বুঝেছি, কিন্তু ভদ্রলোকটিকে মধ্যপ্রাচ্যের কেন দেখলাম, তা বুঝতে পারিনি।
Comments
Post a Comment