দাদু
কয়েকটা ছোট ছোট গল্প শোনাবো বলে আজ সকালে উঠেই ল্যাপটপটা খুললাম। আসলে কাল
বিকেল থেকে বড্ড দাদুর কথা মনে পড়ছে। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেল মারা গেছেন উনি।
হ্যাঁ, নমাসে ছমাসে মনে পড়ে বইকি ওনার কথা। কিন্তু কাল থেকেই বারবার দাদুর
বিভিন্ন স্মৃতি মনের মাঝে ভেসে আসছে। আমাকে আর দাদাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন।
আমাদের যেকোনো রেজাল্ট, প্রাইজ বা অন্য যেকোনো ভালো খবর সমস্ত
আত্মীয়স্বজনকে জানানোটা ছিল ওনার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। মা-বাবা-ঠাকুমা
কেউই এই আনন্দ থেকে কখনও বঞ্চিত করেনি দাদুকে। সেই ঘুরতে গিয়ে হাতির পিঠে
চড়া, রিকশাভাড়া নিয়ে অকারণ তর্ক, কাউকে না বলেকয়ে ডায়মন্ডহারবার ঘুরতে চলে
যাওয়া, বুড়ো বয়সে গোগ্রাসে গল্পের বই গেলা – কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে লোকটাকে
ঘিরে। সব তো আর বলার সুযোগ হয় না, তাই ওসবের মধ্যে থেকেই কয়েকটা গল্প
শোনাই আপনাদের।
রান্নাঘর থেকে ঠাকুমা সবে বাটিভর্তি মুড়ি নিয়ে হাঁটা লাগিয়েছে দাদুর ঘরের
দিকে, হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল ব্যাজারমুখো লোকটা। আর সকাল সকাল
এরকম চেহারার মানে একটাই হতে পারে – প্রাতঃকৃত্য ঠিকঠাক হয়নি আজ।
"এই তো, খাবার নিয়ে আসতে না আসতেই আবার ছুট", রেগেমেগে বলে উঠল ঠাকুমা।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে মায়ের দিকে তাকালাম। বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রায় প্রতিদিন সাতসকালে, যখন বাবার অফিস যাওয়ার তাড়া, তখন এই নাটক চললে রাগ তো হবেই। ওদিকে ঠাকুমা তখনও চালিয়ে যাচ্ছে – "প্রথমে পঞ্চাশবার চেঁচাও যে খাবার দাও, খাবার দাও; আর যখন নিয়ে আসব তখন গিয়ে পায়খানায় ঢুকবে। এত যন্ত্রণা করলে আমি যাই কোথায়।"
"আরে তো আমি কি করব যদি ঠিক করে না হয়। এসব কি আর আমার হাতে নাকি?" বেরিয়ে এসেছে দাদু। আর যথারীতি সেই ডায়লগ, "তোমরা আর কি বুঝবে গো? যার হয়, সে না বোঝে।"
"বুড়ো বয়সে যত ন্যাকামো", আলতো করে বলে মা উঠে গেল রুটি সেঁকতে।
আমিও আবার চায়ে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজে চোখ রাখলাম। এটা আর কি প্রতিদিনের নাটক। তবুও রোজ দেখতে আমার বেশ মজাই লাগে।
"অ্যাই অ্যাই জয়ন্তী", ঘরের ভেতর থেকেই পাড়া-কাঁপানো চিৎকারটা শুনতে
পেলাম। মা-ঠাকুমাও শুনতে পেয়েছে আর সাথে সাথে মা দৌড় লাগিয়েছে বারান্দার
দিকে।
জয়ন্তীপিসি আমাদের বাড়িতে কাজ করে। আজ দুদিন হল ডুব মেরেছে আর বলা বাহুল্য, সমস্ত কাজ নিজেদের হাতে করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে মা-ঠাকুমা দুজনে। এদিকে খোঁজ নেওয়ারও কোনও উপায় নেই যে কেন আসছে না।
আজ সকালে দাদু বারান্দায় দাঁড়িয়ে খবরের কাগজের জন্য অপেক্ষা করছিল আর সেই সময়েই চোখ পড়ে গেছে বরের সাইকেলে বসে থাকা জয়ন্তীপিসির ওপর। কোনও কাজে যাচ্ছিল হয়তো বরের সাথে। কিন্তু আর যায় কোথায়! বাজখাঁই গলার আওয়াজে থামতে হয়েছে।
"এই যে, তোমাকে আর আসতে হবে না", মা বারান্দায় পৌঁছনোর আগেই ক্রুদ্ধস্বরে শুরু করে দিয়েছে দাদু, "না বলেকয়ে এরকম ছুটি দেওয়া যাবে না। অনেক কাজ থাকে বাড়িতে। যখন ইচ্ছা আসবে, যখন ইচ্ছা আসবে না – এসব রঙ্গ চলবে না এখানে। যাও গে।"
অবস্থা বেগতিক বুঝে মা বলল, "আরে আপনি থামুন তো। যান ভেতরে যান। আপনাকে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে কে বলে?"
"আরে না না, এটা কি ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি এখানে। এটা ওর মামার বাড়ি নাকি!"
ন্যায্য কথাই বটে! কিন্তু এটুকু মানিয়ে না চললে আর কাজের লোক কোত্থেকে পাওয়া যাবে। তবে সে কথা বুড়ো মানুষটাকে বোঝায় কে! অগত্যা ঠাকুমা গিয়ে হাল ধরল।
"এই যে, তুমি ভেতরে এস", গম্ভীর গলায় বলে উঠল ঠাকুমা। জানি না কি করে এটা সম্ভব, কিন্তু যখনই ঠাকুমা এরকম গলায় কিছু বলে ওঠে, দাদু বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেয়। আপনমনে গজগজ করতে করতে ভেতরে চলে এল।
তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক সাধ্যসাধনা করে তবে জয়ন্তীপিসিকে আবার কাজ করানোর জন্য রাজি করাতে পেরেছিল মা। শর্ত ছিল একটাইঃ দাদু যদি আবার কিছু বলে কোনও কাজ নিয়ে বা অন্য কিছু নিয়ে, সাথে সাথে কাজ ছেড়ে দেবে।
বলা বাহুল্য, সাতদিন পর থেকেই নতুন কাজের লোক খোঁজা শুরু করতে হয়েছিল বাবা-মাকে।
রোববারের দুপুর মানেই বেশ সুস্বাদু মুরগির ঝোল। ছোটবেলায় এটা বেশ কমন ছিল
আমাদের কাছে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে অপেক্ষা করা কতক্ষণে মায়ের স্নান হবে।
ঠাকুমা স্যালাড কেটে বাটিতে রেখে দিত আর গল্পের বই নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে
সেখান থেকেই এক দুটো শসা-গাজর মুখে চালান করে দিতাম।
তো যেদিনের কথা বলছি, সেদিনও ছিল এরকম এক রবিবার। বাবা সকাল সকাল গিয়ে মুরগি নিয়ে এসেছে। তবে মায়ের ওপর স্ট্রিক্ট অর্ডার ছিল, শুধু ডাল, আলুভাজা আর মাংস। কারণ রাত্তিরে আবার মামাবাড়িতে নিমন্ত্রণ। আমার মামাতো বোনের জন্মদিন।
তবে এর সাথে মাকে একটু কাঁচকলার তরকারিও করতে হয়েছিল। স্পেশাল অর্ডার দাদুর। কারণ আর কিছুই নয়, সকাল থেকে নাকি পেটটা একটু গড়বড়।
কিন্তু খেতে বসে কি আর সেসব মনে থাকে। ডাল, ভাজা, কাঁচকলা খেয়ে হাঁক পাড়ল দাদু, "একটু দু পিস মেটে, একটা আলু আর ঝোল দাও তো। এখন মনে হচ্ছে শরীরটা একটু ঠিকই আছে। অল্প খেয়ে দেখি কেমন করেছ।"
হাঁইহাঁই করে চেঁচিয়ে উঠল ঠাকুমা আর যেরকম ভেবেছিলাম, সেরকম উত্তরই এল, "আমার শরীর কি আর আমি বুঝব না নাকি? তুমি নিজের খাওয়া খাও দেখি। এই লক্ষ্মী, দু পিস দাও তো, কেমন হয়েছে একটু টেস্ট করি।"
লক্ষ্মী আমার মায়ের নাম। বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মা উঠে গেল মাংসের বাটি নিয়ে।
তবে এখানেই শেষ নয়। বয়স হওয়ার পর থেকে দাদু-ঠাকুমা কোনওদিনই জন্মদিন টাইপের ছোট অনুষ্ঠানে যেত না আর সেইজন্য মামাবাড়ি থেকে সেদিন ওদের জন্য একটু পোলাও, আড় মাছের ঝোল, পাঁঠার মাংস আর দু-তিন রকমের মিষ্টি পাঠিয়েছিল। সেদিন রাত্তিরেও তাই সেসব না খেয়ে থাকতে পারেনি দাদু। বড্ড খেতে ভালোবাসতো লোকটা।
ফলটা টের পাওয়া গেছিল পরদিন। দুতিনদিন ভুগিয়েছিল সেবার পেটের অসুখটা।
এটা অনেকদিন পরের কথা। আমি তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। মাধ্যমিকের পর চলে
গেছিলাম হোস্টেলে, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশুনো করতে। ছুটিতে
প্রথমবার এসেছি বাড়িতে আর খবর পেয়েই স্কুলের একদল বন্ধুবান্ধব বিকেলে হাজির
হল। শুভ, ঋক, অরূপ, তিতলি, সৌম্য, ঐন্দ্রিলা আর সানি।
বড্ড মাথা গরম হয়ে গেছিল সেই দিনটায়। অনেকদিন পর দেখা সবার সাথে, কোথায় চুটিয়ে আড্ডা মারব, সে গুড়ে একরাশ বালি ঢেলে দিল বুড়ো লোকটা।
ওরা আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দাদু বেশ সন্দিগ্ধ চোখে এসে উঁকি দিল আমার ঘরে। শুভ, ঋক আর অরূপ ছাড়া কাউকেই চিনত না; তাই সবার সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলাম আমি। তারপর শুরু হল তিতলি আর ঐন্দ্রিলাকে জেরা করা।
ওহ, বলতে ভুলে গেছি, আমি বয়েজ স্কুলে পড়তাম। মেয়েদের সাথে আলাপ বলতে ওই প্রাইভেট টিউশন। তাই বিশাল কৌতূহল নিয়ে পুলিশি জেরা করতে শুরু করেছিল দাদু।
সবটা আজ আর মনে নেই, খালি এটুকু মনে আছে যে আধ ঘণ্টা পর ঠাকুমা আবার এসে বাঁচিয়ে ছিল আমাদের। সেই গম্ভীর গলায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিল আমার ঘর থেকে। আর তারপর সবাই আমাকে কাতরস্বরে অনুরোধ করেছিল যেন আর কখনও বাড়িতে না ডাকি।
"এই দেখো লোকটা আবার রওনা দিল ওখানে। আরে আর কতবার যাবে? ট্রেনের টাইম হয়ে যাচ্ছে তো!"
'ওখানে' মানে বাথরুমে। এটা একটা বাতিক মত ছিল দাদুর। ঠাকুমার শত চেঁচামেচিতেও কোনও কাজ হয়নি কখনও। দার্জিলিং মেল বিকেল পাঁচটা চল্লিশে ছাড়বে। আর এখন পাঁচটা বেজে গেছে কিন্তু ওনার কিছুতেই কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। এটা তৃতীয়বার এই নিয়ে। কিছুই হয় না কিন্তু তাও কিছুতেই মনের শান্তি নেই লোকটার। কোথাও বেরোনোর আগে কয়েকবার করে ওমুখো হতে হয়, নয়তো নাকি রাস্তায় পেয়ে যাবে।
"যতসব মনের অসুখ। এই লোকটাকে নিয়ে হয়েছে আমার যত জ্বালা", ঠাকুমার গজগজ চলছেই ওদিকে। আরও দশ মিনিট পর শেষ অবধি বেরোতে পারলাম আমরা।
তবে হ্যাঁ, ট্রেনে উঠে দাদু ট্রেডমার্ক উক্তিটি করতে ভোলেনি, "হ্যাহ, আজ পর্যন্ত কোনও ট্রেন মিস করিনি। তোমরা অল্পতেই বড্ড অস্থির হয়ে যাও।"
হয়তো একটু অবাক হচ্ছেন না? যে এরকম সাতকাহন করে কেন দাদুর গল্প শোনাচ্ছি।
কারণটা যাই হোক, আগে একবার ভেবে দেখুন, গল্পগুলো আমার দাদুর জীবন থেকে
নেওয়া হলেও আপনাকে কি কারো কথা মনে করায়নি? যেকোনো বয়স্ক মানুষের জীবনেই
বোধহয় এই ঘটনাগুলো ঘটে। একইরকম বাতিক, সবদিক সামলানোর তাগিদ, অপাংক্তেয় মনে
হওয়া নিজেকে – সবকিছুই বড্ড কমন, তাই না?
আর ঠিক এই ঘটনাগুলোই অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেছেন সুজিত সরকার এবং তার পুরো দল – 'পিকু' সিনেমায়। আমি ওপরে শোনালাম আমার দাদুর গল্প, ওখানে দেখানো হয়েছে পিকুর (দীপিকা পাড়ুকোন) বাবা ভাস্কর ব্যানার্জির (অমিতাভ বচ্চন) গল্প।
গল্পগুলো আর ডিটেলে বলছি না, সবই একেবারে দৈনন্দিন জীবন থেকে তুলে বসিয়ে দিয়েছেন। তাই সেটুকু আমি বলার চেয়ে নিজে গিয়ে দেখে নেওয়াই ভালো। খালি এটুকু বলতে পারি, নিজের নিজের ভূমিকায় দীপিকা, অমিতাভ, ইরফান খান, মৌসুমি চ্যাটার্জি প্রত্যেককে অনবদ্য বললেও কম বলা হয়। আর তার সাথে অনুপম রায়ের মিউজিক। কেন যেন মনে হল নিজের স্টাইল ছেড়ে একটু অন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন অনুপম এবং পুরোপুরি সফল।
তবে হ্যাঁ, সিনেমার গল্পে হয়তো আরও একটু মোচড়, অন্য কোনও অ্যাঙ্গেল থাকলে আরও একটু ভালো হত। বড্ড বেশি পেছনদিকের 'মোশন' নিয়ে আলোচনা চলেছে সিনেমাতে, সেটা একটু কম করলেও পারতেন বোধহয় পরিচালক। অবশ্য অন্যদিকে, নিজের দাদুকে যেমন দেখেছি, এই বয়সে হয়তো ওটাই একমাত্র চিন্তার বিষয় থাকে ওনাদের।
সবমিলিয়ে আমার একটাই বক্তব্য – বহুদিন পর এরকম একটা হিন্দি সিনেমা দেখলাম, যেটা পরিবারের সবার সাথে বসে অনায়াসে দেখা যায়, প্রচণ্ড মজা পাওয়া যায় আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার – প্রত্যেকের নিজের জীবনের সাথে মিল পাওয়া যায়। এখনও না দেখে থাকলে অবশ্যই দেখে আসুন, হতাশ হবেন না।
পুনশ্চঃ (স্পয়লার অ্যালার্ট) আমার দাদু সকাল নটার দিকে নিজের বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছিলেন। কোনও রোগ ছিল না, কোনও কষ্ট পাননি। নিঃশব্দে, পরম শান্তিতে, অষ্টাশি বছর বয়সে মারা গেছিলেন উনি। তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, কলকাতায়। দিনটা কখনও ভুলবো না – একুশে অক্টোবর, আমার জন্মদিনের আগেরদিন। আর পরদিন ছিল আমার একটা পরীক্ষা। বাবা খবরটা দেওয়ার পর বলেছিল পরীক্ষা শেষ করে তবেই আসতে। তাই শেষদেখা দেখতে পারিনি দাদুকে। এই সিনেমার শেষে ভাস্করবাবু যেভাবে মারা গেলেন, সেটা দেখে স্বাভাবিকভাবেই দাদুর কথা বড্ড মনে পড়ছিল। সেদিন যা দেখতে পাইনি, আজ এই সিনেমায় সেটাই যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম।
দৃশ্য ১
"এই তো, খাবার নিয়ে আসতে না আসতেই আবার ছুট", রেগেমেগে বলে উঠল ঠাকুমা।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে মায়ের দিকে তাকালাম। বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রায় প্রতিদিন সাতসকালে, যখন বাবার অফিস যাওয়ার তাড়া, তখন এই নাটক চললে রাগ তো হবেই। ওদিকে ঠাকুমা তখনও চালিয়ে যাচ্ছে – "প্রথমে পঞ্চাশবার চেঁচাও যে খাবার দাও, খাবার দাও; আর যখন নিয়ে আসব তখন গিয়ে পায়খানায় ঢুকবে। এত যন্ত্রণা করলে আমি যাই কোথায়।"
"আরে তো আমি কি করব যদি ঠিক করে না হয়। এসব কি আর আমার হাতে নাকি?" বেরিয়ে এসেছে দাদু। আর যথারীতি সেই ডায়লগ, "তোমরা আর কি বুঝবে গো? যার হয়, সে না বোঝে।"
"বুড়ো বয়সে যত ন্যাকামো", আলতো করে বলে মা উঠে গেল রুটি সেঁকতে।
আমিও আবার চায়ে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজে চোখ রাখলাম। এটা আর কি প্রতিদিনের নাটক। তবুও রোজ দেখতে আমার বেশ মজাই লাগে।
দৃশ্য ২
জয়ন্তীপিসি আমাদের বাড়িতে কাজ করে। আজ দুদিন হল ডুব মেরেছে আর বলা বাহুল্য, সমস্ত কাজ নিজেদের হাতে করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে মা-ঠাকুমা দুজনে। এদিকে খোঁজ নেওয়ারও কোনও উপায় নেই যে কেন আসছে না।
আজ সকালে দাদু বারান্দায় দাঁড়িয়ে খবরের কাগজের জন্য অপেক্ষা করছিল আর সেই সময়েই চোখ পড়ে গেছে বরের সাইকেলে বসে থাকা জয়ন্তীপিসির ওপর। কোনও কাজে যাচ্ছিল হয়তো বরের সাথে। কিন্তু আর যায় কোথায়! বাজখাঁই গলার আওয়াজে থামতে হয়েছে।
"এই যে, তোমাকে আর আসতে হবে না", মা বারান্দায় পৌঁছনোর আগেই ক্রুদ্ধস্বরে শুরু করে দিয়েছে দাদু, "না বলেকয়ে এরকম ছুটি দেওয়া যাবে না। অনেক কাজ থাকে বাড়িতে। যখন ইচ্ছা আসবে, যখন ইচ্ছা আসবে না – এসব রঙ্গ চলবে না এখানে। যাও গে।"
অবস্থা বেগতিক বুঝে মা বলল, "আরে আপনি থামুন তো। যান ভেতরে যান। আপনাকে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে কে বলে?"
"আরে না না, এটা কি ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি এখানে। এটা ওর মামার বাড়ি নাকি!"
ন্যায্য কথাই বটে! কিন্তু এটুকু মানিয়ে না চললে আর কাজের লোক কোত্থেকে পাওয়া যাবে। তবে সে কথা বুড়ো মানুষটাকে বোঝায় কে! অগত্যা ঠাকুমা গিয়ে হাল ধরল।
"এই যে, তুমি ভেতরে এস", গম্ভীর গলায় বলে উঠল ঠাকুমা। জানি না কি করে এটা সম্ভব, কিন্তু যখনই ঠাকুমা এরকম গলায় কিছু বলে ওঠে, দাদু বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেয়। আপনমনে গজগজ করতে করতে ভেতরে চলে এল।
তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক সাধ্যসাধনা করে তবে জয়ন্তীপিসিকে আবার কাজ করানোর জন্য রাজি করাতে পেরেছিল মা। শর্ত ছিল একটাইঃ দাদু যদি আবার কিছু বলে কোনও কাজ নিয়ে বা অন্য কিছু নিয়ে, সাথে সাথে কাজ ছেড়ে দেবে।
বলা বাহুল্য, সাতদিন পর থেকেই নতুন কাজের লোক খোঁজা শুরু করতে হয়েছিল বাবা-মাকে।
দৃশ্য ৩
তো যেদিনের কথা বলছি, সেদিনও ছিল এরকম এক রবিবার। বাবা সকাল সকাল গিয়ে মুরগি নিয়ে এসেছে। তবে মায়ের ওপর স্ট্রিক্ট অর্ডার ছিল, শুধু ডাল, আলুভাজা আর মাংস। কারণ রাত্তিরে আবার মামাবাড়িতে নিমন্ত্রণ। আমার মামাতো বোনের জন্মদিন।
তবে এর সাথে মাকে একটু কাঁচকলার তরকারিও করতে হয়েছিল। স্পেশাল অর্ডার দাদুর। কারণ আর কিছুই নয়, সকাল থেকে নাকি পেটটা একটু গড়বড়।
কিন্তু খেতে বসে কি আর সেসব মনে থাকে। ডাল, ভাজা, কাঁচকলা খেয়ে হাঁক পাড়ল দাদু, "একটু দু পিস মেটে, একটা আলু আর ঝোল দাও তো। এখন মনে হচ্ছে শরীরটা একটু ঠিকই আছে। অল্প খেয়ে দেখি কেমন করেছ।"
হাঁইহাঁই করে চেঁচিয়ে উঠল ঠাকুমা আর যেরকম ভেবেছিলাম, সেরকম উত্তরই এল, "আমার শরীর কি আর আমি বুঝব না নাকি? তুমি নিজের খাওয়া খাও দেখি। এই লক্ষ্মী, দু পিস দাও তো, কেমন হয়েছে একটু টেস্ট করি।"
লক্ষ্মী আমার মায়ের নাম। বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মা উঠে গেল মাংসের বাটি নিয়ে।
তবে এখানেই শেষ নয়। বয়স হওয়ার পর থেকে দাদু-ঠাকুমা কোনওদিনই জন্মদিন টাইপের ছোট অনুষ্ঠানে যেত না আর সেইজন্য মামাবাড়ি থেকে সেদিন ওদের জন্য একটু পোলাও, আড় মাছের ঝোল, পাঁঠার মাংস আর দু-তিন রকমের মিষ্টি পাঠিয়েছিল। সেদিন রাত্তিরেও তাই সেসব না খেয়ে থাকতে পারেনি দাদু। বড্ড খেতে ভালোবাসতো লোকটা।
ফলটা টের পাওয়া গেছিল পরদিন। দুতিনদিন ভুগিয়েছিল সেবার পেটের অসুখটা।
দৃশ্য ৪
বড্ড মাথা গরম হয়ে গেছিল সেই দিনটায়। অনেকদিন পর দেখা সবার সাথে, কোথায় চুটিয়ে আড্ডা মারব, সে গুড়ে একরাশ বালি ঢেলে দিল বুড়ো লোকটা।
ওরা আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দাদু বেশ সন্দিগ্ধ চোখে এসে উঁকি দিল আমার ঘরে। শুভ, ঋক আর অরূপ ছাড়া কাউকেই চিনত না; তাই সবার সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলাম আমি। তারপর শুরু হল তিতলি আর ঐন্দ্রিলাকে জেরা করা।
ওহ, বলতে ভুলে গেছি, আমি বয়েজ স্কুলে পড়তাম। মেয়েদের সাথে আলাপ বলতে ওই প্রাইভেট টিউশন। তাই বিশাল কৌতূহল নিয়ে পুলিশি জেরা করতে শুরু করেছিল দাদু।
সবটা আজ আর মনে নেই, খালি এটুকু মনে আছে যে আধ ঘণ্টা পর ঠাকুমা আবার এসে বাঁচিয়ে ছিল আমাদের। সেই গম্ভীর গলায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিল আমার ঘর থেকে। আর তারপর সবাই আমাকে কাতরস্বরে অনুরোধ করেছিল যেন আর কখনও বাড়িতে না ডাকি।
দৃশ্য ৫
'ওখানে' মানে বাথরুমে। এটা একটা বাতিক মত ছিল দাদুর। ঠাকুমার শত চেঁচামেচিতেও কোনও কাজ হয়নি কখনও। দার্জিলিং মেল বিকেল পাঁচটা চল্লিশে ছাড়বে। আর এখন পাঁচটা বেজে গেছে কিন্তু ওনার কিছুতেই কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। এটা তৃতীয়বার এই নিয়ে। কিছুই হয় না কিন্তু তাও কিছুতেই মনের শান্তি নেই লোকটার। কোথাও বেরোনোর আগে কয়েকবার করে ওমুখো হতে হয়, নয়তো নাকি রাস্তায় পেয়ে যাবে।
"যতসব মনের অসুখ। এই লোকটাকে নিয়ে হয়েছে আমার যত জ্বালা", ঠাকুমার গজগজ চলছেই ওদিকে। আরও দশ মিনিট পর শেষ অবধি বেরোতে পারলাম আমরা।
তবে হ্যাঁ, ট্রেনে উঠে দাদু ট্রেডমার্ক উক্তিটি করতে ভোলেনি, "হ্যাহ, আজ পর্যন্ত কোনও ট্রেন মিস করিনি। তোমরা অল্পতেই বড্ড অস্থির হয়ে যাও।"
উপসংহার
আর ঠিক এই ঘটনাগুলোই অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেছেন সুজিত সরকার এবং তার পুরো দল – 'পিকু' সিনেমায়। আমি ওপরে শোনালাম আমার দাদুর গল্প, ওখানে দেখানো হয়েছে পিকুর (দীপিকা পাড়ুকোন) বাবা ভাস্কর ব্যানার্জির (অমিতাভ বচ্চন) গল্প।
গল্পগুলো আর ডিটেলে বলছি না, সবই একেবারে দৈনন্দিন জীবন থেকে তুলে বসিয়ে দিয়েছেন। তাই সেটুকু আমি বলার চেয়ে নিজে গিয়ে দেখে নেওয়াই ভালো। খালি এটুকু বলতে পারি, নিজের নিজের ভূমিকায় দীপিকা, অমিতাভ, ইরফান খান, মৌসুমি চ্যাটার্জি প্রত্যেককে অনবদ্য বললেও কম বলা হয়। আর তার সাথে অনুপম রায়ের মিউজিক। কেন যেন মনে হল নিজের স্টাইল ছেড়ে একটু অন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন অনুপম এবং পুরোপুরি সফল।
তবে হ্যাঁ, সিনেমার গল্পে হয়তো আরও একটু মোচড়, অন্য কোনও অ্যাঙ্গেল থাকলে আরও একটু ভালো হত। বড্ড বেশি পেছনদিকের 'মোশন' নিয়ে আলোচনা চলেছে সিনেমাতে, সেটা একটু কম করলেও পারতেন বোধহয় পরিচালক। অবশ্য অন্যদিকে, নিজের দাদুকে যেমন দেখেছি, এই বয়সে হয়তো ওটাই একমাত্র চিন্তার বিষয় থাকে ওনাদের।
সবমিলিয়ে আমার একটাই বক্তব্য – বহুদিন পর এরকম একটা হিন্দি সিনেমা দেখলাম, যেটা পরিবারের সবার সাথে বসে অনায়াসে দেখা যায়, প্রচণ্ড মজা পাওয়া যায় আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার – প্রত্যেকের নিজের জীবনের সাথে মিল পাওয়া যায়। এখনও না দেখে থাকলে অবশ্যই দেখে আসুন, হতাশ হবেন না।
পুনশ্চঃ (স্পয়লার অ্যালার্ট) আমার দাদু সকাল নটার দিকে নিজের বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছিলেন। কোনও রোগ ছিল না, কোনও কষ্ট পাননি। নিঃশব্দে, পরম শান্তিতে, অষ্টাশি বছর বয়সে মারা গেছিলেন উনি। তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, কলকাতায়। দিনটা কখনও ভুলবো না – একুশে অক্টোবর, আমার জন্মদিনের আগেরদিন। আর পরদিন ছিল আমার একটা পরীক্ষা। বাবা খবরটা দেওয়ার পর বলেছিল পরীক্ষা শেষ করে তবেই আসতে। তাই শেষদেখা দেখতে পারিনি দাদুকে। এই সিনেমার শেষে ভাস্করবাবু যেভাবে মারা গেলেন, সেটা দেখে স্বাভাবিকভাবেই দাদুর কথা বড্ড মনে পড়ছিল। সেদিন যা দেখতে পাইনি, আজ এই সিনেমায় সেটাই যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম।
Comments
Post a Comment