কথোপকথন নাকি খিচুড়ি
রোববারের সকাল। সাতটার দিকে হঠাৎ কোনো এক অজানা কারণে ঘুমটা চটকে গেল। অবশ্য তাতে খুব বেশি কিছু এল-গেল না। মানে এই পি-এইচ-ডি -এর জীবনে রবি-সোম সবই একরকম। অগাধ সময় পাওয়া যায়, কিন্তু করব করব করে আর কিছুই করা হয়ে ওঠে না। এমনকি আমার তো এ সন্দেহও হয় মাঝে মাঝে যে আদৌ শেষ অবধি ডিগ্রীটা পাব তো! যাকগে, ঘুমটা যখন ভেঙেই গেল, অহেতুক সময় নষ্ট না করে কিছু কাজের কাজ করবই, এই ভেবে বেজায় উৎসাহ নিয়ে উঠে পড়লাম। ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা বানিয়ে কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে অভ্যাসবশে ল্যাপটপটা অন করে ফেলেছি, তখনই দুম করে আইডিয়াটা মাথায় চলে এল। অনেকদিন ব্লগটায় লেখা হয়নি, আজ বরং একটা কিছু লিখে ফেলা যাক।
তো মেল-টেল চেক করে চুপ করে বসে ভাবছি কি লিখব, এমন সময় - 'পিড়িং'। মানে ওই আর কি - কেউ একটা এই সাতসকালে চ্যাট করে সময় কাটাতে চায়। খুলে দেখি, আমার এক দূরসম্পর্কের দাদা, যার সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তার আবার সদ্য বিয়ে হয়েছে, মানে একটু বেশি বয়সেই। আর বিয়ের পর থেকেই, জানি না কেন, এই দাম্পত্যজীবন নিয়ে আমার কাছে নানা পরামর্শ চায়। বস্তুত, বিয়ের পর থেকে অন্য কিছু নিয়ে আর কথা বলেই না আজকাল। আজও সেরকমই কিছু হবে নিশ্চয়ই। দেখলাম লিখেছে, "কিরে সকাল সকাল উঠে পড়েছিস আজকের দিনেও? কোথাও বেরোবি নাকি?"
"না, ঘুমটা ভেঙে গেল। ভাবছি ব্লগটায় কিছু লিখি।"
"ওহ, ভালো", বলে একটা আধ মিনিটের বিরতি। আর থাকতে না পেরে নির্লজ্জের মত বলেই ফেললাম, "ভনিতা না করে বলে ফেল কি সমস্যা।"
একটা ছোট ইমোটিকন এলো দেখলাম। ঠিকই ধরেছি। বৌদি নাকি খুব করে ধরেছে অফিস থেকে এক মাসের ছুটি নিয়ে ইউরোপ-ভ্রমণে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর দাদার যথারীতি ছুটি নেই, মানে এই তো ক'মাস আগেই বিয়ের জন্য বেশ কিছু ছুটি নিয়েছে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কি আর মুখ দেখে মাইনে দেবে! তো এখন সে কথা বলতেই বৌদির গতকাল থেকে মুখ ভার। সত্যি কথা বলতে আমি বুঝে পাই না, বৌদির চেয়ে পাক্কা চার বছরের বড় হয়েও কি করে দাদা এরকম ভয়ে ভয়ে থাকে। আমাকে বলল, "তোকে তো পছন্দ করে তোর বৌদি, একটু বুঝিয়ে বল না।"
"আহা, বৌদিকে কি আর ওরম বলা যায়! হাজার হোক, এখনো তো নতুন বৌদি! তুমি একটু বুঝিয়ে বললেই হবে, চিন্তা নেই!"
"বলছিস?"
"অফ কোর্স! তোমায় খুব মানে (এখনো)"
হ্যাঁ, 'এখনো'-টা ইচ্ছে করেই ব্র্যাকেটের মধ্যে লিখেছি। আর যথারীতি, দাদা চাপ খেয়ে গিয়ে বলে ফেলল, "সে কি রে ! কবে থেকে মানবেনা ?"
অনেকক্ষণ ধরেই কবিতা লিখব ভাবছি, কিন্তু এর জ্বালায় তা তো আর হলো না, তাই ভাবলাম এই সুযোগে একটু ভাব নিয়ে আসি মনে; "এই ধরো যখন নতুন প্রেমের রোমাঞ্চটা একটু কমে যাবে, যখন দাম্পত্যে মিষ্টি প্রেমের গান বা কবিতার বদলে লাউঘন্ট না উচ্ছেভাজা কোনটা রাঁধা হবে সেটার আলোচনা বেশি হবে বা যখন একসাথে খেতে গিয়েও শুধু কাজের কথা মনে পড়বে, তখনই বুঝবে আর তোমার আকর্ষণ তোমার কথা শুনতে বাধ্য করবে না।"
"আর কি?"
"উম...তারপর ধর বিয়ের বর্ষপূর্তিতে তোমার সাথে সময় কাটানোর বদলে রান্নাঘরে চিংড়ির মালাইকারী নিয়ে সময় বেশি কাটাতে দেখলে বুঝবে আকর্ষণ কমতির দিকে..."
"তুই বড্ড বেশিদূর দেখছিস। কিন্তু কথাটা ভালো বলেছিস...তবে সেরকম দিন যে আসতেই হবে তার কি মানে আছে বল। মানে প্রেম বলতে হয়ত এই জিনিসগুলোকে বাদ দেওয়া যায়না, কিন্তু সেটা হলে প্রেমের পরিনতি বলে যা লোকে মনে করে সেরকম দিনকে আদৌ আসতে কেন দিতে হবে; তার আগেই তো থেমে যাওয়া যায়।"
খেয়েছে! এ তো বহুগামিতার কথা বলছে মনে হচ্ছে। তবে সত্যিই ভাব এনে বলছে না খিল্লি করে বুঝছি না। কিন্তু কি আর করি, আমি তখন একসাথে ভাব আর খিল্লির সপ্তম স্বর্গে। বললাম, "বাইশে শ্রাবণ দেখেছ তো? বিয়েটা হচ্ছে ডাল-ভাত। তবে সেটা প্রসেনজিতের মতে। আমি বলি, বিয়েটা হচ্ছে অনেকটা খিচুড়ির মত।"
"মানে বিয়ে করলেই জীবনের সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাবে বলছিস !"
যদিও নিজে সেটাই মনে করি, তাও একজন সদ্য বিবাহিতকে সে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। বেশ গুছিয়ে বলা শুরু করলাম, "না না, তা কেন? ধর দুজন হচ্ছে চাল আর ডালের মত, একসাথে মিলে সংসারটা মানে খিচুড়ি তৈরী হবে। তো বিভিন্ন সুখ-দুঃখ হচ্ছে মশলাপাতি; একটু বেশি-কম হলে এক এক রকম স্বাদ জীবনে। আর নুনটা হচ্ছে ভালোবাসা। একেবারে না থাকলে পুরো আলুনি জীবন। আবার বেশি হয়ে গেলেও খারাপ লাগবে। তাই পুরো পরিমিত ভালোবাসা থাকা চাই।"
"অনেকটা ঘুড়ির সুতোর মত মনে হচ্ছে। ঠিক সময়ে ছাড়তে হবে, আবার ঠিক সময়ে টান মারতে হবে।"
ঠিক বুঝলাম না মিলটা যুতসই হলো কিনা। কিন্তু এটুকু বুঝলাম দাদাও মুডে আছে। বলে চললাম, "এবার দেখ, খিচুড়ি রান্না তো সবাই পারে। মানে সংসার সবাই করে। কিন্তু সেটাকে সবসময়ের জন্য নতুন করে রাখো। মানে ধর খিচুড়িতে একদিন একটু কাজু-কিশমিশ দিলে, একদিন ধর মটরশুঁটি-গাজর দিয়ে করলে আবার কোনদিন হালকা করে ঘিয়ের গন্ধ ছড়িয়ে দিলে। এইভাবেই তো প্রেমটা দিনকে দিন জমে উঠবে। আর তাহলে বাড়ির বাইরে খেতে যাবার ইচ্ছেটা খুব একটা হবে না।" একটু থেমে মিচকে হাসির ইমোটিকনটা দিয়ে বললাম, "মানে তোমার বা বৌদির কারোরই হবে না ইচ্ছেটা।"
"শুয়োর", গালি দিয়ে দাদা বলল, "নাহ, খাসা এক্সপ্লেন করলি বটে। তাহলে থেকে থেকে নতুন প্রেম করার চেয়ে পুরনো প্রেমকেই নতুনভাবে শুরু করা ভালো। যাকে বলে 'তোমায় নতুন করে পাব বলে, হারাই ক্ষণে ক্ষণে'। প্রেমে নতুনত্ব আনাটাই জীবনের চ্যালেঞ্জ দেখছি।"
সে আর বলতে। বিয়ে করে ফেলেছ যখন, আর কি করবে বল। মনে মনে বললাম, 'পড়েছ যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে'। "যাকগে, অনেক হয়েছে", লিখলাম অবশেষে, "কাজের কাজ তো কিছুই হলো না, তোমার সাথে বাজে ভাঁট করে সময়টা গেল। উঠি এখন।"
"একটা কাজ কর বরং, ওপরের কথাগুলো না বেশ ভালো বলেছিস। এটাই বরং ব্লগে তুলে দে।"
ভেবে দেখলাম, নাহ, আইডিয়াটা খারাপ দেয়নি। তাই একটু-আধটু এডিট করে ওই সকালের চ্যাটটাই এখানে লিখে ফেললাম।
পুনশ্চ: দাদাটি পরে আমাকে বলেছিল, ঐদিন রাতে (ভুলে যাবেন না, শীতের রাত) বেশ সুন্দর খিচুড়ি আর পাঁপড়ভাজা (দাদা-বৌদি আবার নিরামিষাশী, তাই ডিমভাজা কি ইলিশমাছভাজার স্বাদে বঞ্চিত) সহযোগে ডিনারের পর বৌদিকে একমাসের ইউরোপ ট্রিপের বদলে এক সপ্তাহের জন্য গোয়া ঘুরতে যেতে রাজি করিয়ে ফেলেছে।
ভেবে দেখলাম, নাহ, আইডিয়াটা খারাপ দেয়নি। তাই একটু-আধটু এডিট করে ওই সকালের চ্যাটটাই এখানে লিখে ফেললাম।
পুনশ্চ: দাদাটি পরে আমাকে বলেছিল, ঐদিন রাতে (ভুলে যাবেন না, শীতের রাত) বেশ সুন্দর খিচুড়ি আর পাঁপড়ভাজা (দাদা-বৌদি আবার নিরামিষাশী, তাই ডিমভাজা কি ইলিশমাছভাজার স্বাদে বঞ্চিত) সহযোগে ডিনারের পর বৌদিকে একমাসের ইউরোপ ট্রিপের বদলে এক সপ্তাহের জন্য গোয়া ঘুরতে যেতে রাজি করিয়ে ফেলেছে।
(এই লেখাটি একটি আসল কথোপকথন অবলম্বনে, যেটুকু বদল ঘটানো হয়েছে সেটা কিছুটা আমার কল্পনা আর বাকিটা দূরদর্শিতা )
eta chorom kintu....
ReplyDelete