অস্তরাগ
।। ১ ।।
"তারপর রাজকন্যা মৈত্রেয়ীকে অত্যাচারী রাজা চন্দ্রনাথ
জোর করে ধরে নিয়ে যায় বিয়ে করবে বলে। মৈত্রেয়ীর বাবা রাজা হলেও আসলে ছিলেন চন্দ্রনাথের
অধীনেই। চন্দ্রনাথের বিরোধিতা করার মত লোকবল, বাহুবল বা মনোবল কোনটাই ছিল না তার।
তাই এই অনাচারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারলেন না তিনি।
যথাসময়ে তাদের বিয়ে হয়। এদিকে মৈত্রেয়ীর জীবনে সুখ বলতে কিছু
রইল না আর। সে তখন অসহায়ভাবে পথ খুঁজছে রাজার কবল থেকে মুক্তি
পাওয়ার। এসময় তার আলাপ হয় নীলাব্জ নামে একজনের সাথে। নীলাব্জ চন্দ্রনাথেরই
বন্ধু, রাজকার্য চালাতে সাহায্য করত। শান্ত, বুদ্ধিমান, স্থিতধী নীলাব্জকে প্রথম
দেখায়ই মৈত্রেয়ীর খুব
ভালো লেগে যায়।"
"স্থিতধী মানে কি যেন মা?"
"মানে ও কাজের সময়
খুব বুদ্ধি করে চলত আর যেকোনো বিপদ থেকে শান্তভাবে বেরিয়ে আসত।"
"আচ্ছা, তারপর বলো
. . ."
"তারপর নীলাব্জর
সাথে মৈত্রেয়ীর খুব তাড়াতাড়ি ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। আর মৈত্রেয়ীও ওর কাছে নিজের সব
দুঃখের কথা খুলে বলল। নীলাব্জ ইতিমধ্যেই মৈত্রেয়ীকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। ওর এই কষ্টের
কথা শুনে ঠিক করল চন্দ্রনাথকে হত্যা করেই মৈত্রেয়ীকে উদ্ধার করতে হবে আর ওকে বিয়ে করবে।
এরপর একদিন সেটাই হল। নীলাব্জ চন্দ্রনাথকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে বিয়ে করে মৈত্রেয়ীকে।
তারপর থেকে তারা একসাথে সুখে জীবন কাটায়।"
"আর সেই
যুদ্ধ? সেটা কেন বাদ দিলে মা? বলো না সেটা . . ."
"ওটা তো
অনেকবার শুনেছ সোনা। এখন ঘুমিয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে যে। আজ আর নয়।"
তিন বছরের বাধ্য
ছেলে আর দ্বিরুক্তি না করে চোখ বোজে। আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াতে
থাকে শর্মিলা। হঠাৎ সোনা চোখ খুলে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, "বাবা কবে আসবে মা?"
"আসবে তো সোনা, যুদ্ধ শেষ হলেই চলে আসবে। এখন ঘুমোও, আর দেরী করে না।"
আর কি উত্তর দেবে শর্মিলা! দু বছরেরও বেশি হল সমর যুদ্ধে গেছে। আগে তাও ছমাসে একবার আসত। এবার প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্ক উত্তরোত্তর অবনতি হওয়ায় একবারও ছুটি পায়নি এই ক'দিনে। ছেলের মনেও নেই তার বাবা কেমন দেখতে। প্রতিদিন সকালে উঠেই মনে হয় আজই বুঝি সমরের মৃত্যুসংবাদ আসবে। কিন্তু না, আরও একটা দিন কেটে যায়। ছেলে রাতে আবার বাবার কথা জানতে চায়। একই নাটকের পুনরাবৃত্তি ঘটে চলে প্রতিদিন। এমনিতে শর্মিলার জীবনে সমর খুব সামান্য স্থানই অধিকার করে রয়েছে। বিয়ের পর খুব কম সময়েই তারা একসাথে থাকার সুযোগ পেয়েছে। আর ছুটিছাটায় যখন আসে, অধিকাংশ সময়েই নেশা করে আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে কাটিয়ে দেয়। তাও প্রতিদিন সকালে আশায় বুক বাঁধে মন। ছেলেটার মুখ চেয়ে। ওরও তো বাবার দরকার। ঘুমন্ত ছেলের পাশে শুয়ে ঘরের সিলিংটার দিকে চেয়ে অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে থাকে শর্মিলা।
।। ২ ।।
হাতের ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আকাশ। ছবিটা সমরের ব্যাগ থেকে পাওয়া। সমরের চোখদুটোকে যেন বড্ড বেশি জীবন্ত দেখাচ্ছে। একরাশ ঘৃণা ঝরে পড়ছে চোখদুটো থেকে। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে থাকল আকাশের। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে। কাঁধের ওপর হাত দিয়ে ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কাছে টেনে নিল বিজয়। মুখ তুলে তাকাল আকাশ। চারপাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। মাধব, বিশাল, অলোক, সিংজী সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রত্যেকের চোখ থেকে যেন ছিটকে বেরোচ্ছে কথাগুলো, "কেন একটু দেখে গুলিটা চালালে না আকাশ? সমর তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল। যতই ভুল করে থাকো না কেন, আসলে তুমি খুনি, নিজের হাতে বন্ধুকে মেরেছ। ছিঃ আকাশ . . .
আর থাকতে পারল না আকাশ। বিজয়ের কাঁধে মাথা রেখে বলে উঠল, "সব মুঝসে নফরত কর রহে হ্যায় ইয়ার।"
"নেহি আকাশ, অ্যায়সা কুছ ভি নেহি। হামলোগ সব জানতে হ্যায় কেয়া হুয়া থা। তু ফিকর মত কর, সব ঠিক রহেগা। ডোন্ট ওরি।"
চিন্তিত সিংজী দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, "ব্যস ইয়ে সোচনা হ্যায় কি উসকি ঘরওয়ালি কো ক্যায়সে বাতায়েগা। তুঝে হি তো যানা পড়েগা আকাশ।"
"মুঝে লাগ রহা হ্যায় সচ বাতানেসে কুছ ফায়দা নেহি, উনলোগ গলত সোচ সকতে হ্যায়," বলল বিশাল।
সিংজীও সম্মতি জানালেন, "মেরা ভি এহি মাননা হ্যায়, বেহতর হোগা . . ."
"আচ্ছা ঠিক হ্যায়," বাকিদের থামিয়ে বলে উঠল বিজয়, "আভি ইয়ে সব ছোড়ো। পেহলে সবকুছ খতম হোনে দো, ফির দেখা যায়েগা। ওয়সে আকাশ সমরকা সবসে আচ্ছা দোস্ত থা, ও খুদ হি সোচ লেগা কেয়া ঠিক হোগা। আভি রেস্ট লেনা চাহিয়ে হাম সবকো।"
বিজয়ের কথায় খুব কৃতজ্ঞ বোধ করল আকাশ। ধীরে ধীরে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বারবার মনে পড়ছে শর্মিলা আর সোনার কথা। ওদের জীবনে সমর ছাড়া আর কেউ ছিল না। সমর শর্মিলা দুজনেরই বাবা-মা অনেকদিন হলো মারা গেছেন। সমরকে অনেকবার সাধারণ চাকরি নিতে বলেছিল শর্মিলা, রাজি হয়নি। সমরের এক বুড়ি পিসিই শুধু ছিলেন শর্মিলার সঙ্গী। তিনিও মারা যাবার পর থেকে সোনাকে নিয়েই সময় কাটে ওর। শেষ যেবার সমরদের বাড়ি যায় সোনা তখন তিনমাসের। দুজনের একটা ছবি ছিল আকাশের কাছে। একদৃষ্টে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে ও।
চিন্তিত সিংজী দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, "ব্যস ইয়ে সোচনা হ্যায় কি উসকি ঘরওয়ালি কো ক্যায়সে বাতায়েগা। তুঝে হি তো যানা পড়েগা আকাশ।"
"মুঝে লাগ রহা হ্যায় সচ বাতানেসে কুছ ফায়দা নেহি, উনলোগ গলত সোচ সকতে হ্যায়," বলল বিশাল।
সিংজীও সম্মতি জানালেন, "মেরা ভি এহি মাননা হ্যায়, বেহতর হোগা . . ."
"আচ্ছা ঠিক হ্যায়," বাকিদের থামিয়ে বলে উঠল বিজয়, "আভি ইয়ে সব ছোড়ো। পেহলে সবকুছ খতম হোনে দো, ফির দেখা যায়েগা। ওয়সে আকাশ সমরকা সবসে আচ্ছা দোস্ত থা, ও খুদ হি সোচ লেগা কেয়া ঠিক হোগা। আভি রেস্ট লেনা চাহিয়ে হাম সবকো।"
বিজয়ের কথায় খুব কৃতজ্ঞ বোধ করল আকাশ। ধীরে ধীরে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বারবার মনে পড়ছে শর্মিলা আর সোনার কথা। ওদের জীবনে সমর ছাড়া আর কেউ ছিল না। সমর শর্মিলা দুজনেরই বাবা-মা অনেকদিন হলো মারা গেছেন। সমরকে অনেকবার সাধারণ চাকরি নিতে বলেছিল শর্মিলা, রাজি হয়নি। সমরের এক বুড়ি পিসিই শুধু ছিলেন শর্মিলার সঙ্গী। তিনিও মারা যাবার পর থেকে সোনাকে নিয়েই সময় কাটে ওর। শেষ যেবার সমরদের বাড়ি যায় সোনা তখন তিনমাসের। দুজনের একটা ছবি ছিল আকাশের কাছে। একদৃষ্টে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে ও।
।। ৩ ।।
সমরের মৃত্যু হয়েছে অনেকদিন হয়ে গেল। এখনো ওর বাড়িতে কেউ মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে দেয়নি। সমর বহুদিন আগেই আকাশকে অনুরোধ করেছিল ও মারা গেলে শর্মিলা যেন সে খবর আকাশের থেকেই পায়। আজ সেই দিন। এক সপ্তাহ হলো সীমান্তে পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে, ছুটি পেয়েছে আকাশ। কাল রাতে বাড়ি ফিরেছে আর সকাল হতেই এসেছে শর্মিলার বাড়িতে।
বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখল শর্মিলা বাগানে গাছের পরিচর্যা করছে। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় ভারি পবিত্র দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল আকাশ। ইতিমধ্যেই শর্মিলার চোখ পড়েছে আকাশের ওপর। এক লহমায় ব্যাপারটা বুঝে গেল। আস্তে আস্তে গেটের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, "বেঁচে নেই?"
মাথা নাড়ল আকাশ। খবরটা শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল শর্মিলা। তারপর খুব ধীরে জানতে চাইল, "কবে ঘটেছে?"
"অনেকদিন, প্রায় ছ'মাস। মাঝে কোনো খবর দেওয়া হয়নি, জানোই তো সমরের . . ."
"হুঁ . . . কবে এলে?"
"কাল রাতে।"
"আকাশ, আমি রিয়েলি সরি, আমার জন্য এতটা কষ্ট করতে হলো বলে।"
"না না, ঠিক আছে . . ." বলতে গেল আকাশ। কিন্তু শর্মিলা নিজের মত বলে চলেছে, "জানো আকাশ, প্রতিদিন সকালে উঠেই মনে হত এই খবরটা পাবো। ছেলেটা রোজ রাতে বাবার খবর জানতে চায়। চেহারাও মনে নেই বেচারার। আমিও প্রাণপণ চেষ্টা চালাতাম ভুলে যাবার জন্য। বিয়ের এই পাঁচটা বছরে বিভিন্নভাবে দুঃখ দেওয়া ছাড়া আর তো কিছুই করেনি। একদিন, একদিন ওর সব ছবি পুড়িয়ে ফেললাম . . ."
একটু থেমে আকাশের দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালো শর্মিলা। তারপর মৃদুস্বরে বলে উঠল, "আজ মনে হচ্ছে মুক্তি পেলাম। সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে পারব কোনোদিন ভাবতে পারিনি। থ্যাঙ্ক ইউ আকাশ।" বলে মুখের মৃদু হাসিটা অক্ষত রেখেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠল শর্মিলা, "সোনা, তাড়াতাড়ি বাইরে আয়। দেখে যা, তোর বাবা এসেছে।"
আজ মনটা বড় হালকা লাগছে শর্মিলার। নতুন জীবন ফিরে পেল মনে হচ্ছে। খালি সোনাকে সেই যুদ্ধের গল্পটা আর শোনানো হবে না, "একদিন চন্দ্রনাথের রাজ্য আক্রমণ করে পাশের রাজ্যের রাজা রত্নার্ঘ্য। সেই রাজার সুবিশাল সৈন্যবাহিনীর কাছে চন্দ্রনাথের সেনারা দ্রুত পরাজিত হতে থাকে। পরিস্থিতি সামলাতে চন্দ্রনাথ নিজে যায় যুদ্ধে। পাশে যুদ্ধবিদ্যায় পটু বহুদিনের সঙ্গী নীলাব্জ। তারা অসামান্য যুদ্ধকৌশলে প্রতিপক্ষকে হারাতে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ যখন প্রায় শেষের দিকে, সেসময় একদিন নীলাব্জ সুযোগ বুঝে তলোয়ার চালিয়ে দেয় চন্দ্রনাথের বুকে। মৃত্যু হয় চন্দ্রনাথের। যুদ্ধ শেষ হলে চন্দ্রনাথের ভাই বসে সিংহাসনে। রাজা হওয়ার লোভ কোনদিনই ছিল না নীলাব্জর। সে বিয়ে করে মৈত্রেয়ীকে আর বাকি জীবন একসাথে সুখে কাটায় তারা।"
eta shera, ekdom opore
ReplyDelete