সেই লোকটা
সালটা ১৯৯৩ বোধহয়। তখন সদ্য সদ্য পড়তে শিখেছি। মানে শুধু স্বরবর্ণ ব্যাঞ্জনবর্ণ নয়, রীতিমত উপুড় হয়ে শুয়ে বুকে বালিশ গুঁজে, ছোট্ট ছোট্ট পা দুটো দোলাতে দোলাতে গল্পের বই গোগ্রাসে পড়ার কথা বলছি। ওই সময়টাকে আজকালকার ছেলেমেয়েরা কল্পনায়ই আনতে পারবে না বোধহয়। বাড়িতে খুব ছোট্ট একটা সাদা-কালো টিভি একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম। তাও সিরিয়াল বা সিনেমা (মানে আমি গুগাবাবার কথা বলছি না) দেখার ব্যাপারে বেশ বড় বয়স অবধি আমার নিজের ইচ্ছে বা বাবা-মায়ের অনুমতি কোনটাই ছিল না। অবসর সময়ে বিনোদন বলতে তাই বিভিন্ন স্বাদের গল্পের বই। আর বাড়িতে সাড়ে পাঁচ বছরের বড় বইপাগল দাদা থাকায় গল্পের বইয়ের অভাব কখনই হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সমস্ত ধরনের বই পড়তে দেওয়া হত না তখন (অবশ্য ওই বয়সে আমাকে 'লজ্জা' পড়তে দিলে কিছু বুঝতাম তো না-ই, উল্টে হয়তো কৌতুহলের চোটে বখেই যেতাম), তাই নতুন পুরনো আনন্দমেলাই ছিল প্রধান সঙ্গী। তো এরকমই একদিন ১৯৯১ সালের একটা আনন্দমেলা (স্মৃতির ওপর ভর করে বলছি, মোটের ওপর বেশ পুরোনো) হাতে পাই বাড়ির কোনো এক কোণ থেকে আর ধুলো ঝেড়ে নিয়ে গিয়ে বসি বিছানায়। সেই সংখ্যাটা ছিল এক বিস্ময় বালক কে নিয়ে, যে কিনা মাত্র ষোলো বছর বয়সেই ক্রিকেটে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে। সেদিনই প্রথম জানতে পারলাম তার নাম আর ওই পুরো প্রচ্ছদকাহিনীর মধ্যে এমন কিছু ছিল যেটা আমায় বাধ্য করে ক্রিকেট খেলাটাকে ভালোবেসে ফেলতে। অচিরেই দাদাকে ধরে নিয়মকানুন শিখলাম আর তারপর থেকে শুরু হলো নিয়ম করে খবরের কাগজের খেলার পাতা পড়ে ফেলা, সুযোগ হলেই দূরদর্শনে খেলা দেখা আর ক্রিকেট সম্পর্কে যত পারা যায় জেনে নেওয়া। তো সে যাগগে, এখানে তো আর আমার ক্রিকেটজ্ঞানের ইতিহাস বর্ণনা করতে বসিনি, শুধু একটা লোকের গল্প যে একটা ছোটো বাচ্চাকে একটা খেলায় আকৃষ্ট করতে পারে এটা বোঝানোর জন্যই এই অবতারণা। বিশ্বাস করুন, এ শুধু আমার কথা নয়, পুরো দেশের কোটি কোটি শিশু ওই একটা লোকের জন্য খেলা দেখা শুরু করেছে, ক্রিকেটার হতে চেয়েছে আর মনপ্রাণ দিয়ে ক্রিকেটকে ভালোবেসেছে।
এই অবধি পড়ে যদি আমাকে ওই ভদ্রলোকের অন্ধ ভক্ত মনে করে থাকেন, তাহলে একটু ভুল করছেন। জীবনে বহুবার বহু বন্ধুর সাথে এই নিয়ে ঝগড়া করেছি যে ওয়ান-ডে ম্যাচে ক'বার রান তাড়া করতে নিয়ে ও সেঞ্চুরি করেছে, বা ক'টা টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে বড় রান করেছে, এমনকি টেস্টে ক'টাই বা ডাবল সেঞ্চুরি আছে। ডন ব্রাডম্যান, ব্রায়ান লারা এদের কথা ছেড়েই দিন, রাহুল দ্রাবিড়ও টেস্টে ভারতের হয়ে চাপের মুখে হয়তো বেশি ভালো খেলেছে। সেই তর্কে আমি যেতে চাই না, শুধু এই কথাটা ভাবুন কেন সবাই এরকম কোনো চাপের ম্যাচে ভারত হেরে গেলে ওকেই দায়ী করত। কই, ছোটবেলায় তো কখনো কাউকে বলতে শুনিনি যে 'ইস, মনোজ প্রভাকর খেলতে পারল না বলে এই ম্যাচটা হেরে গেল।' আসলে কি জানেন, আমরা সবসময় এটাই জানতাম যে ভরসা করার লোক একজনই আছে। আমি নিজে খুব ভালো বলতে পারব কোন কোন ম্যাচে ও খেলতে পারেনি বলে ভারত হেরেছে, কারণ ওইদিনগুলোতে প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে ঘুমোতে গিয়েছিলাম আর বারবার ওই একজনকেই দোষ দিয়েছিলাম। ওই একটা লোকই সমস্ত দেশবাসীর সুখ-দুঃখের সাথী ছিল, ভরসার জায়গা ছিল। ক্রিকেটীয় রেকর্ডে কে সেরা সেই তর্ক ভুলে একবার ভাবুন এই জায়গাটা আর ক'জন তাদের জীবদ্দশায় অর্জন করতে পেরেছে। আমি নিজে স্ট্যাটিসটিক্স-এর ছাত্র, বিশ্বাস করুন স্কোরবোর্ড কখনই মানুষের ভালোবাসা, আবেগ, আশা এগুলো মাপতে পারে না। আর তাই পরিসংখানের কচকচি দিয়ে যারা বলছেন, এ তো বিশ্বের ঊনত্রিশতম সেরা ব্যাটসম্যান, তারা একবার বাকি আঠাশ জনের একজনও একশো দশ কোটি মানুষের আবেগ কাঁধে নিয়ে খেলতে নিয়েছিল কিনা ভেবে দেখুন। আশা করি আপনার ধারণা বদলাবে।
আর ভারতরত্ন?! একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এই বাজারে খুব চেঁচামেচি করছেন যে ধ্যানচাঁদ, বিশ্বনাথন আনন্দ এদের না দিয়ে ওকে এখন এই খেতাব দেওয়াটা সম্পূর্ণ ভুল। তাদের মতে এটা শুধুই কংগ্রেসের চাল। হয়তো তাই। কিন্তু খেতাব দেওয়াটা কি সত্যিই ভুল? মানে ধ্যানচাঁদ হকিতে দেশকে দীর্ঘদিন বিশ্বের দরবারে শীর্ষস্থানে রেখেছেন, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি লোক একডাকে চেনে ওঁকে, হিটলার থেকে ব্রাডম্যান সবাই শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন, লন্ডনে টিউব-স্টেশন, ভিয়েনায় মূর্তি রয়েছে ওঁর সম্মানে। সবই মানছি। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ধ্যানচাঁদকে ভারতরত্ন দেওয়া উচিত। কিন্তু তাই বলে যে মানুষটা ক্রিকেটে একইরকম কীর্তি রেখেছে, তাকে কেন দেওয়া হবে না বলতে পারেন? রেকর্ডগুলো দেখুন একবার। ওয়ান-ডে ক্রিকেটের তো সমস্ত ব্যাটিং রেকর্ডেই ওই একজনের নাম। আর টেস্টেও অধিকাংশ রেকর্ডের ভাগীদার। সবচেয়ে বড় কথা একটানা চব্বিশ বছর ধরে এরকম শারীরিক সক্ষমতার খেলায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করা, তাও সবসময় খেলার মান সাধারণের থেকে অনেক ওপরে রেখে, আর কেউ পেরেছে বলে তো মনে পড়ছে না। পৃথিবীর বহু দেশে (যত কম দেশই খেলুক না কেন) লোকে ভারতীয় ক্রিকেট বলতে ওই একজনকেই বোঝে। বিশ্বদরবারে এভাবে দেশের নাম উজ্জ্বল করাটা কি ভারতরত্ন পাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়? তাই আমার মনে হয় ওকে কেন দেওয়া হয়েছে এই নিয়ে না চেঁচিয়ে বরং যাতে এরপর দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো রাজনীতিকের বদলে ধ্যানচাঁদ বা আনন্দের মত যোগ্য ব্যক্তিকে দেওয়া হয় সেটা নিয়ে এখন থেকেই চেঁচানো শুরু করাটা ভালো। সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই, ওই পদকটার কথা না ভেবে একবার সেই দিনটার কথা ভাবুন। একজন একটা খেলা থেকে অবসর নেবে বলে সারা দেশের (এবং দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশের) শত কোটি মানুষ একসুরে কাঁদছে, সেই লোকটার কি তখনই ভারতরত্ন পাওয়া হয়ে গেল না?
এই অবধি পড়ে যদি আমাকে ওই ভদ্রলোকের অন্ধ ভক্ত মনে করে থাকেন, তাহলে একটু ভুল করছেন। জীবনে বহুবার বহু বন্ধুর সাথে এই নিয়ে ঝগড়া করেছি যে ওয়ান-ডে ম্যাচে ক'বার রান তাড়া করতে নিয়ে ও সেঞ্চুরি করেছে, বা ক'টা টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে বড় রান করেছে, এমনকি টেস্টে ক'টাই বা ডাবল সেঞ্চুরি আছে। ডন ব্রাডম্যান, ব্রায়ান লারা এদের কথা ছেড়েই দিন, রাহুল দ্রাবিড়ও টেস্টে ভারতের হয়ে চাপের মুখে হয়তো বেশি ভালো খেলেছে। সেই তর্কে আমি যেতে চাই না, শুধু এই কথাটা ভাবুন কেন সবাই এরকম কোনো চাপের ম্যাচে ভারত হেরে গেলে ওকেই দায়ী করত। কই, ছোটবেলায় তো কখনো কাউকে বলতে শুনিনি যে 'ইস, মনোজ প্রভাকর খেলতে পারল না বলে এই ম্যাচটা হেরে গেল।' আসলে কি জানেন, আমরা সবসময় এটাই জানতাম যে ভরসা করার লোক একজনই আছে। আমি নিজে খুব ভালো বলতে পারব কোন কোন ম্যাচে ও খেলতে পারেনি বলে ভারত হেরেছে, কারণ ওইদিনগুলোতে প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে ঘুমোতে গিয়েছিলাম আর বারবার ওই একজনকেই দোষ দিয়েছিলাম। ওই একটা লোকই সমস্ত দেশবাসীর সুখ-দুঃখের সাথী ছিল, ভরসার জায়গা ছিল। ক্রিকেটীয় রেকর্ডে কে সেরা সেই তর্ক ভুলে একবার ভাবুন এই জায়গাটা আর ক'জন তাদের জীবদ্দশায় অর্জন করতে পেরেছে। আমি নিজে স্ট্যাটিসটিক্স-এর ছাত্র, বিশ্বাস করুন স্কোরবোর্ড কখনই মানুষের ভালোবাসা, আবেগ, আশা এগুলো মাপতে পারে না। আর তাই পরিসংখানের কচকচি দিয়ে যারা বলছেন, এ তো বিশ্বের ঊনত্রিশতম সেরা ব্যাটসম্যান, তারা একবার বাকি আঠাশ জনের একজনও একশো দশ কোটি মানুষের আবেগ কাঁধে নিয়ে খেলতে নিয়েছিল কিনা ভেবে দেখুন। আশা করি আপনার ধারণা বদলাবে।
আর ভারতরত্ন?! একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এই বাজারে খুব চেঁচামেচি করছেন যে ধ্যানচাঁদ, বিশ্বনাথন আনন্দ এদের না দিয়ে ওকে এখন এই খেতাব দেওয়াটা সম্পূর্ণ ভুল। তাদের মতে এটা শুধুই কংগ্রেসের চাল। হয়তো তাই। কিন্তু খেতাব দেওয়াটা কি সত্যিই ভুল? মানে ধ্যানচাঁদ হকিতে দেশকে দীর্ঘদিন বিশ্বের দরবারে শীর্ষস্থানে রেখেছেন, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি লোক একডাকে চেনে ওঁকে, হিটলার থেকে ব্রাডম্যান সবাই শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন, লন্ডনে টিউব-স্টেশন, ভিয়েনায় মূর্তি রয়েছে ওঁর সম্মানে। সবই মানছি। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ধ্যানচাঁদকে ভারতরত্ন দেওয়া উচিত। কিন্তু তাই বলে যে মানুষটা ক্রিকেটে একইরকম কীর্তি রেখেছে, তাকে কেন দেওয়া হবে না বলতে পারেন? রেকর্ডগুলো দেখুন একবার। ওয়ান-ডে ক্রিকেটের তো সমস্ত ব্যাটিং রেকর্ডেই ওই একজনের নাম। আর টেস্টেও অধিকাংশ রেকর্ডের ভাগীদার। সবচেয়ে বড় কথা একটানা চব্বিশ বছর ধরে এরকম শারীরিক সক্ষমতার খেলায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করা, তাও সবসময় খেলার মান সাধারণের থেকে অনেক ওপরে রেখে, আর কেউ পেরেছে বলে তো মনে পড়ছে না। পৃথিবীর বহু দেশে (যত কম দেশই খেলুক না কেন) লোকে ভারতীয় ক্রিকেট বলতে ওই একজনকেই বোঝে। বিশ্বদরবারে এভাবে দেশের নাম উজ্জ্বল করাটা কি ভারতরত্ন পাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়? তাই আমার মনে হয় ওকে কেন দেওয়া হয়েছে এই নিয়ে না চেঁচিয়ে বরং যাতে এরপর দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো রাজনীতিকের বদলে ধ্যানচাঁদ বা আনন্দের মত যোগ্য ব্যক্তিকে দেওয়া হয় সেটা নিয়ে এখন থেকেই চেঁচানো শুরু করাটা ভালো। সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই, ওই পদকটার কথা না ভেবে একবার সেই দিনটার কথা ভাবুন। একজন একটা খেলা থেকে অবসর নেবে বলে সারা দেশের (এবং দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশের) শত কোটি মানুষ একসুরে কাঁদছে, সেই লোকটার কি তখনই ভারতরত্ন পাওয়া হয়ে গেল না?
Comments
Post a Comment